ধামেকা স্তুপ |
মহাতীর্থসারনাথ
বৌদ্ধ শাস্ত্রমতে সারনাথ হল চারটি বৌদ্ধ মহা তীর্থস্থানের অন্যতম। প্রথমটি লুম্বিনী, গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান। দ্বিতীয়টি হল বুদ্ধগয়া, যেখানে বুদ্ধের সম্যক জ্ঞানলাভ, তথা বুদ্ধত্ব প্রাপ্তি। তৃতীয় সারনাথ, বৌদ্ধধর্ম এবং বৌদ্ধসংঘের জন্মস্থান। চতুর্থ কুশিনগর, যেখানে ভগবান বুদ্ধ মহানির্বাণ লাভ করেন।
সারনাথের
মিউজিয়ামে রক্ষিত একটি পাথরে পর পর খোদিত এই চারটি তীর্থস্থানের উল্লেখ পাওয়া যায়।
জাতকের
গল্পে উল্লেখ আছে পঞ্চম ও ষষ্ঠ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে ষোলটি মহজনপদের মধ্যে বারাণসী একটি
উল্লেখযোগ্য মহজনপদ, যার রাজধানী ছিল ঋষিপতন মৃগদাব। সংস্কৃতে ঋষিপতন মৃগদাব পালিতে
উচ্চারিত হয় ইষিপতন মৃগদাব নামে।
মহাভস্তু নামে বৌদ্ধ গ্রন্থে এই নামকরণের উত্সের সন্ধান পাওয়া যায়। কাশী থেকে প্রায় দুই ক্রোশ দূরে ছিল এক মৃগদাব। প্রায় পাঁচশ জন 'প্রত্যেক বুদ্ধ' এখানে বসবাস করেছেন। বৌদ্ধশাস্ত্রমতে যাঁদের সম্যক জ্ঞানলাভ অর্থাৎ বুদ্ধত্ব লাভ হয়নি তাঁদেরকেই বলা হত 'প্রত্যেক বুদ্ধ'। এই ঋষিগণের নির্বাণ লাভ তথা 'পতন' থেকেই এই মৃগদাবের নাম ঋষিপতন ।
বৌদ্ধধর্মের স্বর্ণ যুগের শেষপর্বে যখন হিন্দুরা বৌদ্ধধর্মের বিনাশে মেতে উঠেছিল, তখন প্রত্যেক বৌদ্ধবিহার ধ্বংস করে সেখানে একটি করে শিবের মন্দির তৈরি করা হত। সম্ভবত: ঋষিপতন মৃগদাবের বৌদ্ধবিহার ধ্বংস করে সেখানে সারঙ্গনাথের মন্দির স্থাপিত হয়েছিল। বাম হস্তে মৃগ ধারণ করা শিবের মূর্তিকেই সারঙ্গনাথ বলা হয়ে থাকে। আর সেই সংস্কৃত সারঙ্গনাথ থেকেই কালক্রমে প্রাকৃতে সারনাথ নামকরণ। বর্তমান সারনাথে এখনও একটি জলের ট্যাঙ্কের নাম সারঙ্গতালাব।
ইষিপতন
মৃগদাব নামের আড়ালে একটি সুন্দর গল্প কথিত আছে। মৃগদাব এবং মৃগদায় এই দুটি শব্দই পাওয়া
যায় পালি ভাষার অভিধানে। মৃগদায় শব্দের অর্থ মৃগকে দেওয়া হয়েছে এমন। কথিত আছে রোহিত
নামে এক মৃগরাজ প্রায় ১০০০ মৃগ নিয়ে এখানকার জঙ্গলে বসবাস করতেন। বৃদ্ধ হলে তিনি তাঁর
দুই সন্তান ন্যগ্রোধ এবং বৈশাখের হাতে এই মৃগকুলের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব তুলে দেন।
তৎকালীন
বারাণসীর রাজা ব্রহ্মদত্ত প্রতিদিন সেই জঙ্গলে মৃগয়ায় আসতেন। যত মৃগ তিনি বধ করতেন
তার বহুগুণ বেশি আহত হত এবং গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করে মৃত্যুর পর ঈগলের খাদ্যে পরিণত
হত। মৃগরাজ ন্যগ্রোধ এবং তাঁর ভাই বৈশাখ এই নির্মম হত্যা বন্ধ করার প্রয়াসে রাজা ব্রহ্মদত্তের
নিকট প্রার্থনা জানালেন, মহামান্য রাজা, আপনার রাজ্যে যেমন গ্রাম ও শহরগুলি মানুষ এবং
গৃহপালিত পশুর সম্ভারে সজ্জিত, তেমনি এই জঙ্গল নদী, ঝরনা, পাখি আর মৃগের দ্বারা শোভিত।
আপনি
মহান রাজা। আপনার রাজত্বে শহরগুলির মতই জঙ্গল রক্ষণাবেক্ষণের দায়ও আপনার। তাই আমাদের
প্রার্থনা, আপনি যদি দয়া করে মৃগয়া বন্ধ করেন তবে আমরা প্রতিদিন আপনার দরবারে একটি
করে মৃগ উপঢৌকন পাঠাবার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।
ব্রহ্মদত্ত
ন্যগ্রোধের প্রার্থনা মঞ্জুর করলেন।
নিয়মের
চাকা একদিন ঘুরে এসে দাঁড়ালো এক গর্ভবতী মৃগমায়ের সামনে। মৃগরাজের কাছে সে অনুরোধ করল
সন্তানের জন্মপর্যন্ত তাকে সময় দেওয়া হোক। তখন ন্যগ্রোধ অন্যান্য মৃগদের আহ্বান করলেন,
কিন্তু কেউ রাজি হল না রাজার খাদ্যে পরিণত হতে। তখন ন্যগ্রোধ আপন প্রতিশ্রুতি রক্ষা
করার জন্য নিজেই রাজার নিকট যেতে মনস্থ করলেন। বারাণসীর রাজপথ দিযে রাজদরবারে যাওয়ার
পথে সমস্ত নগরবাসীও মৃগরাজের অনুসরণ করতে লাগল এবং রাজার নিকট ন্যগ্রোধের আত্মোত্সর্গের
কাহিনি তুলে ধরে মৃগের প্রাণভিক্ষা চাইল।
নিজের
আশ্রিত মৃগের প্রাণ রক্ষার জন্য আপন প্রাণ বিসর্জন দিতেও কুন্ঠাবোধ করে না দেখে স্তম্ভিত
হয়ে গেলেন রাজা ব্রহ্মদত্ত। নিজের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত হলেন। মৃগরাজের কতৃত্বে ছেড়ে
দেওয়া হল ওই জঙ্গল যাতে সমস্ত মৃগ নির্ভয়ে বসবাস করতে পারে এবং জঙ্গলে মৃগয়া করা নিষিদ্ধ
ঘোষণা করে দিলেন। সেই "মৃগকে দেওয়া হল" থেকেই মৃগদায় নামের উত্পত্তি। তাই
'মৃগদায়' এবং মৃগদাব দুটো নামেরই উল্লেখ পাওয়া যায়।
সারনাথে প্রতিষ্ঠিত একটি বুদ্ধ মুর্তি |
ধামেকাস্তুপ
বর্তমান
বেনারস থেকে স্থলপথে ১০ কিলোমিটার উত্তরে সারনাথে পৌঁছলে যেটি সর্বপ্রথম চোখে পড়ে তা
হল ধামেকা স্তুপ। উচ্চতা প্রায় ১১২ ফুট এবং ৯৩ ফুট ব্যাসের এই বিরাট স্তুপটি তৈরি করেছিলেন
সম্রাট অশোক, সপ্তম শতাব্দীতে। নিচের পীঠশিলা থেকে ৩৭ ফুট পযন্ত স্তুপের নির্মাণ পাথরের
এবং বাকি অংশ ইঁটের তৈরি। স্তুপটিকে ঘিরে তার গায়ে আটটি বড় শেল্ফ গাঁথা আছে, যেখানে
বুদ্ধমূর্তি রাখা ছিল বলে অনুমান করা হয়।
ধামেকা স্তুপের অলঙ্করণ
স্তুপের
নিচের দিকে আছে মনোরম অলঙ্করণ, যা আজও বেনারসী সিল্ক শাড়ির ডিজাইনে ব্যবহৃত হয়। এই
ধামেকা স্তুপটিই সেই পবিত্র স্থান বলে উল্লিখিত হয়েছে, যেখানে বুদ্ধদেব পঞ্চভার্গব
ভিক্ষুকে প্রথম ধর্মচক্রপ্রবর্তন সূত্র ব্যাখ্যা করেছিলেন ।
বুদ্ধগয়ায় বোধিসত্ত্ব লাভ করার পর গৌতম বুদ্ধ তা প্রচার করার জন্য পঞ্চভার্গব ভিক্ষুর সন্ধানে প্রথম এসে পৌঁছলেন সারনাথে। তিনি যখন শ্রমণ গৌতম, নিরঞ্জনা নদীর তীরে মানুষের মুক্তির সন্ধানে রত, তখন পঞ্চভার্গব ভিক্ষু কোন্ডন্য, বপ্প, ভদ্দিয়, মহানাম এবং অশ্বজিৎ তাঁর সতীর্থ ছিলেন। কিন্তু সিদ্ধার্থ যখন কঠোর তপশ্চর্যার পথ ত্যাগ করে দেহকে নিপীড়ন করা বন্ধ করলেন এবং বিষয়ে পরিমিত আহার-নিদ্রাকে বরণ করলেন তখন এই পাঁচ ভিক্ষু তাঁকে ব্রাত্য ভেবে ত্যাগ করেন।
পরমজ্ঞান
লাভ করার পর বুদ্ধদেব যখন সদ্ধর্মের প্রথম প্রচার করার জন্য কাশী অভিমুখে যাত্রা করলেন
তখন পঞ্চভার্গব ভিক্ষু সারনাথে। গৌতমের সারনাথে আসার সংবাদ পেলে তাঁরা ঠিক করলেন তাঁকে
অভিবাদন করবেন না। কিন্তু সিদ্ধার্থ তাঁদের সমীপবর্তী হলে তাঁরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে
দেখলেন, তাঁরা পাঁচজনেই সিদ্ধার্থকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করছেন। কিন্তু সেখানেই বিস্ময়ের
শেষ হল না। গৌতম বুদ্ধ আসন গ্রহণ করলে ভিক্ষুগণ যখন তাঁকে শ্রমণ গৌতম বলে সম্বোধন করলেন,
তিনি বললেন- না, আমি আর গৌতম নই। সম্যক জ্ঞান প্রাপ্ত হয়ে আমি এখন তথাগত বুদ্ধ।
এই
সারনাথ মৃগদাবেই বুদ্ধদেব প্রথম উচ্চারণ করলেন তাঁর সদ্ধর্মের মূল বাণী। আবর্তিত হল
সর্বপ্রথম মহাধর্মচক্র। ইন্দ্রিয়জ সুখ সন্ধান এবং ইন্দ্রিয় নিপীড়ন এই দুই চরম পথ পরিত্যাগ
করে মধ্যপথ অবলম্বন করতে হবে। জ্ঞানের পথই সেই মধ্যপথ। অষ্টাঙ্গিক সত্যমার্গ। সম্মা-দিঠট
বা সত্য দৃষ্টি, সম্মা-সঙ্কপ্পো বা সত্য সংকল্প, সম্মা-বাচা বা সত্য বাক্য, সম্মা-কম্মন্তো
বা সৎ কর্ম, সম্মা-আজীবো বা সৎ জীবিকা, সম্মা-বায়ামো বা সৎ উদ্যোগ, সম্মা-সতি বা সৎ
চিন্তা, সম্মা-সমাধি বা সৎ ধ্যান।
পঞ্চভার্গব
ভিক্ষুকে তিনি ব্যাখ্যা করে বললেন, বন্ধন দু:খ কী? বন্ধন দু:খের মূল কারণ কী? এবং বন্ধন
দু:খের মূলোত্পাটনের উপায় কী? জন্ম, ব্যাধি, জরা, মৃত্যুই হল সেই বন্ধন। এই বন্ধনজাত
দু:খই বন্ধন দু:খ।
ইন্দ্রিয়জ
সুখের কামনা, আত্মতৃপ্তির বাসনা এবং অহংবোধজাত যশের আকাঙক্ষাই বন্ধন দু:খের মূল। তাই
কামনা বাসনাকে নি:শেষে পরিত্যাগ করাই বন্ধন দু:খের মূলোচ্ছেদের উপায় যা অষ্টমার্গের
পথেই সম্ভব।
এভাবেই
জাগতিক দু:খের হাত থেকে মানুষের মুক্তির সন্ধান দিলেন তথাগত। বুদ্ধের মুখে অষ্টমার্গের
বিশ্লেষণ শুনে পঞ্চভার্গব ভিক্ষু অভিভূত হলেন। মনে হল মানুষের দু:খের মূল এমন করে এর
আগে কেউ ব্যাখ্যা করেননি। নতুন যুগের বার্তা নিয়ে শুরু হল বৌদ্ধধর্ম। সারনাথেই প্রথম
প্রতিষ্ঠিত হল বৌদ্ধ ভিক্ষু সংঘ।
মৌর্যযুগে
অশোকের আমল থেকে সারনাথের বৈভব শুরু হয়। সপ্তম শতাব্দীতে চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙের
তথ্যে সারনাথে সম্রাট অশোকের তৈরি ৩টি মনুমেন্টের উল্লেখ আছে, অশোক স্তম্ভ, বৌদ্ধ বিহার
এবং ধর্মরাজিকা স্তুপ। ১১০ ফুট ব্যাসের পীঠশিলার ওপর তৈরি হয়েছিল এই স্তুপটি। স্তুপের
অস্তিত্ব বিলোপ হলেও পীঠশিলাটি আজও বিদ্যমান।
৩২ টি স্পোর্ক সহ ধর্ম চক্র |
ধর্মরাজিকাস্তুপের পীঠশিলা
ধর্মরাজিকা
স্তুপের ভেতর সবুজ মূল্যবান পাথরে তৈরি একটি বাক্সে মণিমুক্তো ও সোনার পাতের সঙ্গে
বুদ্ধের অস্থি সংরক্ষিত ছিল। কিন্তু ১৭৯৪ খ্রিষ্টাব্দে বারাণসীর হিন্দু রাজা চেতসিং-র
দেওয়ান জগৎসিং নিজের নাম অক্ষয় করার আকাঙক্ষায বারাণসীতে নিজের নামাঙ্কিত জগৎগঞ্জ মহল্লা
তৈরি করলেন এবং ধ্বংস করলেন সারনাথের ধর্মরাজিকা স্তুপ। জগৎগঞ্জ মহল্লা তৈরির সমস্ত
পাথর আসে ধর্মরাজিকা স্তুপ ভেঙে। স্তুপের ভেতর সংরক্ষিত মূল্যবান পাথরগুলি তিনি আত্মসাৎ
করেন এবং অস্থিগুলি নিক্ষেপ করেন গঙ্গায়।
১৮৩৪
খ্রিষ্টাব্দে জেনারেল কানিংহামের নেতৃত্বে সারনাথে শুরু হয় প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান।
এই সময়ে আবিষ্কৃত কিছু শিলালিপি থেকে জানা যায় ধর্মরাজিকা স্তুপ ষষ্ঠ শতকের তৈরি। স্তুপ
ছাড়াও অসংখ্য মূর্তি আবিষ্কৃত হয় সারনাথে। বৌদ্ধ বিহারের একটি ঘরের মধ্যে প্রায় ৬০টি
মূর্তি একত্রে পাওয়া যায়। সম্ভবত: মৌর্য বংশের পতনের পর হিন্দু রাজা পুষ্যমিত্র সুঙ্গের
বুদ্ধবিদ্বেষের ভয়ে বৌদ্ধ শ্রমণগণ এই সমস্ত মূর্তিগুলিকে অসম্মানের হাত থেকে বাঁচাবার
জন্য একটি ঘরের মধ্যে সংরক্ষণ করেন।
কানিংহামের
তত্ত্বাবধানে ৬০টি মূর্তি স্থানান্তরিত করা হয় কলকাতার মিউজিয়ামে এবং বাকিগুলি নিক্ষেপিত
হয় বরুণা নদীর ওপর ডানকান ব্রিজ তৈরির কাজে!
প্রত্নতাত্ত্বিক
খননে আবিষ্কৃত হয়েছে সম্রাট অশোকের আমলে তৈরি মনোলিথিক রেলিং। প্রায় ২.৫ মিটার লম্বা
এবং ১.৫ মিটার উচ্চতার এই রেলিংগুলি চুনার বালিপাথরের তৈরি মনোলিথিক ব্লক। এদের অদ্ভুত
সুন্দর পালিশ আজও অক্ষত। ধর্মরাজিকা স্তুপকে ঘিরে ছিল এই রেলিংগুলির অবস্থান।
বুদ্ধের
প্রথম উপাসকের একটি সুন্দর গল্পের উল্লেখ পাওয়া যায় বৌদ্ধশাস্ত্রে। বারাণসীর রাজার
কোষাধ্যক্ষের পুত্র যশ অগাধ বিত্তবৈভবের মধ্যে নিমজ্জিত ছিলেন। গ্রীষ্ম, বর্ষা আর বসন্তের
দিনযাপনের জন্য ছিল তাঁর তিনটি পৃথক অট্টালিকা।
একবার
বর্ষাকালীন প্রাসাদে সংগীত পটিয়সীদের সান্নিধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। প্রায় চারমাস অতিবাহিত
হলে এক রাত্রে হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখলেন, তাঁর লীলাসঙ্গিনীরা যে যেমনভাবে ছিল সেই ভাবেই
ঘুমিযে পড়েছে। কারো হাতে মৃদঙ্গ, কারো হাতে বীণা আবার কারো বা খোলা মুখ থেকে লালা নি:সরণ
হচ্ছে, কেউ বা নাসিকাধ্বনি করছে।
লাস্যময়ীদের
এই ঘুমন্ত রূপ দেখে তাঁর বিবমিষা উপস্থিত হল। ভোগ-সর্বস্য জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে
তিনি ঘর ছাড়লেন। বারাণসীর উত্তরে ইষিপতন মৃগদাবে উপস্থিত হয়ে দেখা পেলেন স্বয়ং বুদ্ধের।
বুদ্ধ তাঁর সুকুমার হৃদযের সন্ধান পেয়ে সাদরে গ্রহণ করলেন, উদ্বুদ্ধ করলেন অষ্টমার্গের
পথে। পুত্রের সন্ধানে এলেন পিতা। কিন্তু তিনিও বাঁধা পড়ে গেলেন বুদ্ধের অভূতপূর্ব দর্শনের
জালে। আকৃষ্ট হলেন বৌদ্ধধর্মের অষ্টমার্গিক পথে। বুদ্ধ তাঁকে মার্গপ্রদর্শকের নির্দেশাবলী
এবং ত্রিরত্ন "বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘ" এর আশ্রয় প্রদান করলেন।
কোষাধ্যক্ষ,
তাঁর পরিবারের সকলে এবং বন্ধুরাও ক্রমে ক্রমে বুদ্ধের উপাসক হয়ে উঠলেন। কিছুদিন ব্রহ্মচর্য
পালন করার পর বুদ্ধদেব যশকে প্রব্রজ্যা দিলেন। বৌদ্ধ মাইথোলজি অনুযায়ী এই কোষাধ্যক্ষ,
যশের পিতাই হলেন বুদ্ধের প্রথম উপাসক।
মূলগন্ধকুটিবিহার
সারনাথের
প্রধান বৌদ্ধবিহার ছিল মূলগন্ধকুটি বিহার। ধর্মরাজিকা স্তুপ থেকে প্রায় ১৮ ফুট দূরত্বে
অবস্থিত এই বিহারে স্বয়ং বুদ্ধ বাস করেছিলেন। বৌদ্ধভক্তের অর্পিত ধুপ-দীপ আর ফুলে সর্বদা
এই বিহার অপূর্ব সুগন্ধে ভরপুর থাকত। তাই এর নাম মূলগন্ধকুটি। সম্ভবত: শ্রাবস্তির গন্ধকুটি
বিহার থেকে ভিন্ন করার জন্যই 'মূল' শব্দটির আগমন ।
সপ্তম
শতাব্দীর চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙের তথ্য অনুযায়ী ২০০ ফুট উচ্চতার মূলগন্ধকুটি বিহার
ছিল সোনার চন্দ্রাতপে আচ্ছাদিত। প্রত্নতাত্ত্বিক খননে জানা যায় প্রায় ৬০ স্কোয়ার ফুট
প্লটের ওপর বিস্তৃত ছিল এই বিহার এবং একে ঘিরে ছিল ৪০ ফুট চওড়া প্ল্যাটফর্ম।
১২০০
খ্রীষ্টাব্দে কনৌজের রাজা গোবিন্দচন্দ্রের বুদ্ধভক্ত স্ত্রী রানী কুমারদেবীর প্রায়
২৬টি শ্লোকের শিলালিপি পাওয়া যায় সারনাথে। রানী কুমারদেবী মূলগন্ধকুটি বিহারের সংস্কারসাধন
করেন এবং ধর্মচক্রমুদ্রায় বুদ্ধের এক বিরাট অপরূপ মূর্তি তৈরি করেছিলেন। বৌদ্ধশাস্ত্রে
এই মূর্তির উল্লেখ পাওয়া যায়।
সারনাথের
আরো একটি বিখ্যাত আবিষ্কার অশোক-স্তম্ভ। ইতিহাস বলে, বুদ্ধদেব তাঁর সারাজীবনে তাঁর
শিষ্যদের নিকট ৮৪০০০ ধর্মসূত্রের ব্যাখ্যা দেন। এই সংখ্যা অনুযায়ী সম্রাট অশোক তাঁর
সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে ৮৪০০০ অশোক স্তম্ভ নির্মাণ করেন। কার্তিক মাসের অমাবস্যা
তিথিতে এই স্তম্ভগুলির উদ্যাপন হত।
সম্ভবত:
সেই থেকেই এই তিথিতে দীপাবলী উত্সবের প্রবর্তন। সারনাথের অশোক স্তম্ভ কয়েক টুকরো খণ্ডে
আবিষ্কৃত হয়। স্তম্ভের লায়ন ক্যাপিটালের মাথায় বসানো ছিল ৩২টি স্পোকযুক্ত এক বিরাট
ধর্মচক্র। প্রায় অক্ষত লায়ন ক্যাপিটাল এবং ধর্মচক্রের খণ্ডগুলি সারনাথের মিউজিয়ামে
রক্ষিত আছে।
ধর্মচক্রপ্রবর্তনমুদ্রায় বুদ্ধ
সারনাথে
আবিষ্কৃত বুদ্ধমূর্তিগুলির মধ্যে সর্বপ্রধান হল ১.৬ মিটার উচ্চতার ধর্মচক্রপ্রবর্তনের
মুদ্রায় বুদ্ধমূর্তি। গুপ্তযুগের ভাস্কর্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন এই মূর্তি। চুনাপাথরের
তৈরি এই মূর্তির জ্যোতির্বলয়ে আছে পদ্মের মনোরম কারুকার্য এবং দুটি ধর্মচক্রপ্রবর্তন
মুদ্রায় বুদ্ধ বোধিসত্বের মূর্তি।
বুদ্ধকে
ঘিরে আছে দুটি সুন্দর মৃগমূর্তি এবং পঞ্চভার্গব ভিক্ষু, যাঁদের নিকট বুদ্ধ প্রথম ধর্মচক্রপ্রবর্তন
সূত্র ব্যাখ্যা করেছিলেন। বুদ্ধের আসনটিও একটি ধর্মচক্র। গভীর জ্ঞান এবং শান্তির অপরূপ
সহাবস্থান বুদ্ধমূর্তিটিকে বিশিষ্ট করেছে। এই মূর্তিটিকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ উপবিষ্ট বুদ্ধমূর্তি
হিসেবে গণ্য করা হয়।
নতুনমূলগন্ধকুটি বিহার
রানী
কুমারদেবীর পর দীর্ঘ ৭০০ বছর পরে শ্রীলঙ্কার বৌদ্ধ উপাসক আঙ্গারিকা ধর্মপালা আবার সারনাথের
সংস্কার সাধন শুরু করেন।
মহাবোধি
সোসাইটির ডাইরেক্টর জেনারেল আঙ্গারিকা ধর্মপালা হনুলুলুর মেরি এলিজাবেথ ফস্টারের সহায়তায়
১৯২২ খ্রীষ্টাব্দে নতুন করে চুনার পাথরে মূলগন্ধকুটি বিহার নির্মাণ করেন। বর্তমান সারনাথের
প্রধান দ্রষ্টব্য এই মূলগন্ধকুটি বিহার।
নতুন
মূলগন্ধকুটি বিহারের অবস্থান একটি বোধিবৃক্ষের পাশে। সম্রাট অশোকের কন্যা সংঘমিত্রা
বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারের জন্য বুদ্ধগয়ার বোধিবৃক্ষের চারা রোপণ করেছিলেন শ্রীলঙ্কার অনুরাধাপুরে।
আঙ্গারিকা
ধর্মপালা সেই বোধিবৃক্ষের একটি শাখা স্থাপন করেছিলেন সারনাথে। এখনও দেশ বিদেশ থেকে
বহু বৌদ্ধ ভিক্ষুর আগমন ঘটে এই বোধিবৃক্ষের পাশে।
বর্তমানের
এই মূলগন্ধকুটি বিহার জাংআপানি চিত্রকর কসেটসু নাসুর আঁকা বুদ্ধের বহু চিত্রমালার সম্ভারে
সজ্জিত। তথাগত বুদ্ধের জীবনের কাহিনিগুলি অপরূপ রঙ ও রেখায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে। সারনাথের
ধর্মচক্রমুদ্রায় বুদ্ধ ছাড়াও এই ছবিগুলির বিষয়বস্তু লুম্বিনীতে বুদ্ধের জন্মকাহিনি,
বুদ্ধগয়ায় বোধিসত্বলাভ এবং কুশিনগরের নির্বাণলাভ ইত্যাদি।
মূল লেখা: পরবাস থেকে কপিকৃত
আমাদের কমেন্ট করার জন্য ধন্যবাদ। আমরা আপনার কমেন্ট পড়া মাত্র প্রতিক্রিয়া জানাতে চেষ্টা করবো।