মিলিন্দপ্রশ্ন (পর্ব-০৫)


লক্ষ্মণপ্রশ্ন
প্রথম বর্গ

প্রজ্ঞপ্তি প্রশ্ন

অতঃপর রাজা মিলিন্দ আয়ুষ্মান নাগসেন সমীপে উপনীত হইলেন এবং তাহার সহিত অভিনন্দন যথাযোগ্য সম্ভাষণ সমাধা করিয়া এক প্রাতে বসিলেন। আয়ুস্মান নাগসেনও প্রত্যভিনন্দন দ্বারা রাজা মিলিন্দের চিত্ত প্রসন্ন করিলেন।
তখন, রাজা নাগসেনকে জিজ্ঞাসা করিলেন- “ভন্তে! কি প্রকারে আপনি পরিচিত হন, আপনার শুভ নাম কি?” মহারাজ! নাগসেন নামে আমি পরিচিত হই, আর আমার ব্রহ্মচারিগণ আমাকে নামে ডাকেন। মহারাজ! যদিও পিতা-মাতা নাগসেন, শূরসেন, বীরসেন কিংবা সিংহসেন এই জাতীয় কোন নাম রাখিয়া থাকেন, কিন্তু নাগসেনাদি কেবল ব্যবহার করিবার নিমিত্ত আখ্যা, সংজ্ঞা, প্রজ্ঞপ্তি নামমাত্র; কেননা, ইহাতে কোন পুদ্গলের (আত্মার) উপলব্ধি হয় না।
২। তখন রাজা মিলিন্দ কহিলেন- “হে পঞ্চশত যবনগণ, অশীতি সহস্র ভিক্ষুগণ! আপনারা শুনুন, এই নাগসেন বলিতেছেন- এই স্থলে কোন পুদ্গলের (আত্মার) উপলব্ধি হয় না’ - ইহা অভিনন্দনের যোগ্য কি?”
তখন রাজা নাগসেনকে বলিলেন- “ভন্তে নাগসেন! যদি কোন পুদগল বা আত্মা না থাকে তবে কে আপনাদিগকে চীবর, ভোজন, শয়নাসন রোগ প্রত্যয়ভৈষজ্য উপকরণ দেয়? কে উহা পরিভোগ করে? কে শীল রক্ষা করে? কে ধ্যানসাধনায় নিযুক্ত হয়? কে আর্যমার্গফল নির্বাহ সাক্ষাৎ করে? কে প্রাণিহত্যা করে? কে পরদ্রব্য হরণ করে? কে ব্যভিচার করে? কে মিথ্যা বলে? কে মদ্যপান করে? কে এই পঞ্চ আনন্তরীয় কর্ম করে? যদি তাহা হয় তবে পাপ নাই, পূণ্য নাই, পাপ-পূণ্য কর্মের কোন কর্তা বা কারক নাই, সুকৃত-দুস্কৃত কর্মের কোন ফল-বিপাক নাই। ভন্তে নাগসেন। যদি কেহ আপনাকে হত্যা করে তবে তাহারও প্রাণিহত্যা হইবে না। ভন্তে নাগসেন! তবে আপনাদের কেহ আচার্য নাই, উপাধ্যায় নাই, আপনাদের উপসম্পদাও নাই। আপনি যে বলিতেছেন, মহারাজ! ব্রহ্মচারিগণ আমাকে নাগসেন নামে সম্বোধন করেন’-তবে এখানে নাগসেন কে? ভন্তে আপনার কেশ কি নাগসেন?”
না, মহারাজ!”
লোম কি নাগসেন?"
না, মহারাজ!”
নখ, দন্ত, ত্বক, মাংস, স্নায়, অস্থি, অস্থি-মজ্জা, বক্ষ, হৃদয়, যকৃৎ, ক্লোমা,  প্লীহা, ফুসফুস, অন্ত্র, অন্ত্রবন্ধনী, উদরীয় (উদরস্থ খাদ্য), বিষ্ঠা, পিত্ত, শ্লেষ্মা, পূষ, রক্ত, স্বেদ, মেদ, অশ্রু, বসা, থুথু, সিকনি, লালা, মূত্র অথবা মস্তকস্থ মগজ কি নাগসেন?”
না, মহারাজ!'
ভন্তে! আপনার রূপ কি নাগসেন?”
না, মহারাজ!”
আপনার বেদনা কি নাগেসন?”
না, মহারাজ!”
আপনার সংজ্ঞা কি নাগসেন?”
না, মহারাজ!”
আপনার বিজ্ঞান কি নাগসেন?“
না, মহারাজ!”
তাহা হইলে কি রূপ বেদনা সংজ্ঞা সংস্কার বিজ্ঞান নাগসেন?”
না, মহারাজ!”
রূপ-বেদনা-সংজ্ঞা-সংস্কার-বিজ্ঞান ব্যতীত আর কিছু নাগলেন?”
“না, মহারাজ!”
ভন্তে! প্রশ্ন করিতে করিতে নাগসেনকে দেখিতেছি না। তবে নাগসেন শব্দ মাত্রই কি নাগসেন? শেষ পর্যন্ত এখানে নাগসেন কে? ভন্তে! আপনি মিথ্যা বলিতেছেন। নাগসেন কেহ নাই
তখন, আয়ুস্মান নাগসেন রাজা মিলিন্দকে কহিলেন- “মহারাজ! আপনি ক্ষত্রিয় সু-কুমার, দেহ অতি সুকোমল। এই মধ্যাহ্ন সময়ে তপ্তভূমি, উষ্ণ তপ্ত বালুকা প্রখর কাকর-পাথর মর্দন করিয়া পদব্রজে আসায় নিশ্চয় আপনার পা ব্যাথা করিতেছে, দেহ ক্লান্ত হইয়াছে, মন অবসন্ন হইয়াছে, দুঃখ-যুক্ত, কায়-বিজ্ঞান উৎপন্ন হইয়া থাকিবে। আপনি কি এখানে পদব্রজে আসিয়াছেন অথবা কোন যানবাহনে আসিয়াছেন?"
ভন্তে! আমি পদব্রজে আসি নাই। রথে চড়িয়া আসিয়াছি।
মহারাজ! যদি আপনি রথে করিয়া আসেন তবে আপনার রথ কি আমাকে বলুন! মহারাজ! ঈশা দন্ড কি রথ?"
না, ভান্তে!”
অক্ষ কি রথ?”
না, ভান্তে!”
চক্র কি না?”
না, ভান্তে!”
“রথপঞ্জর কি রথ?
না, ভান্তে!”
রথদন্ড কি রথ?"
না, ভান্তে!”
“রথযুগ কি রথ?”
"না, ভন্তে।"
রথরজ্জ্ব কি রথ?"
"না, ভন্তে!”
চাবুক কি রথ?"
না, ভন্তে!”
মহারাজ! তবে ঈশা, অক্ষ চক্র, রথপঞ্জর রথদন্ড, রজ্জু চাবুক একযোগে কি রথ?"
না, ভন্তে।
মহারাজ! ঈশা অক্ষ চক্র রথপঞ্জর রথদন্ড রজ্জু চাবুক ব্যতীত। অন্য কিছু কি রথ?"
না, ভন্তে!"
"মহারাজ! আপনাকে প্রশ্ন করিয়া করিয়া রথ কোথাও দেখিতে পাইলাম না ? রথ শব্দই কি তবে রথ? প্রকৃতপক্ষে এখানে রথ কি? মহারাজ! আপনি মিথ্যা কথা বলিতেছেন। রথ নাই। মহারাজ! সমগ্র জম্বুদ্বীপে আপনি সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা, কাহার ভয়ে আপনি মিথ্যা বলিতেছেন? হে পঞ্চশত যবনগণ, অশীতি সহস ভিক্ষুগণ! আপনারা শুনুন! রাজা মিলিন্দ বলিতেছেন- “আমি রথে করিয়া আসিয়াছি।' ‘যদি মহারাজ! আপনি রথে করিয়া আসেন, তবে রথ কি আমাকে বলুন। এই কথা জিজ্ঞাসা করায় তিনি রথ নির্ণয় করিতে পারিতেছেন না। তাহার কথা অভিনন্দনযোগ্য কি?”
৪। এইরূপ কথিত হইলে পঞ্চশত যবনগণ আয়ুস্মান নাগসেনকে সাধুবাদ। দিয়া রাজা মিলিন্দকে কহিলেন- “মহারাজ! আপনি সমর্থ হইলে এখন উত্তর দিন।
তখন, রাজা মিলিন্দ নগসেনকে কহিলেন- “ভন্তে নাগসেন! আমি মিথ্যা বলি নাই। ঈশা অক্ষ চক্র রথপঞ্জর রথদন্ডাদির 'রথ' এই আখ্যা, সংজ্ঞা, প্রাপ্ত নাম কেবল ব্যবহার বচনেই প্রচলিত হয়।
উত্তম মহারাজ! আপনি রথ কি জানিয়াছেন। এই প্রকারেই মহারাজ! কেশ ইত্যাদিকে আশ্রয় করিয়া কেবল ব্যবহারের নিমিত্ত নাগসেন' এই এক কথিত হয়। কিন্তু পরমার্থ হিসাবে এখানে কোন পুদ্গল (আত্মা) বিদ্যমান নাই। মহারাজ! বজিরা ভিক্ষুণী ভগবানের সম্মুখে বলিয়াছিলেনঅঙ্গসমূহকে আশ্রয় করিয়া যেমন রথ এই নাম ব্যবহৃত হয়, সেইরূপ পঞ্চস্কন্ধকে উপলব্ধি করিয়াসত্ত্ব (জীব) এই ব্যবহার প্রযুক্ত হয়।
ভন্তে নাগসেন। বড়ই আশ্চর্য! বড়ই অদ্ভুত। আপনি অতি বিচিত্র উপায়ে গভীর প্রশ্নের উত্তর দিলেন। যদি এই সময় বুদ্ধ থাকিতেন তবে আপনাকে এইভাবে সাধুবাদ দিতো- ‘সাধু, সাধু নাগসেন। অতি বিচিত্র উপায়ে তুমি গভীর প্রশ্নের উত্তর দিয়াছ।

বর্ষ গণনা প্রশ্ন

৫।ভন্তে নাগসেন! আপনি কত বর্ষ হইয়াছেন অর্থাৎ আপনার ভিক্ষুবয়স কত?
“মহারাজ! আমি সপ্ত বর্ষীয়।"
ভন্তে! এখানে সপ্ত কি, আপনি সপ্ত, অথবা গণনা সপ্ত?"
সেই সময় সর্ব-আভরণ-ভূষণ সুসজ্জিত রাজা মিলিন্দের ছায়া ভূমিতে পড়িয়াছে, উদকমণিতেও প্রতিবিম্ব দেখা যাইতেছে। উহা দেখাইয়া আয়ুষ্মন নাগসেন জিজ্ঞাসা করেন- “মহারাজ! ভূমিতে আপনার ছায়া পড়িয়াছে, উদকমণিতেও প্রতিবিম্ব দেখা যাইতেছে। মহারাজ! আপনি রাজা, না ছায়া রাজা!”
ভন্তে নাগসেন! আমিই রাজা, ছায়া রাজা নহে, কিন্তু ছায়া আমার আশ্রয়েই উৎপন্ন হইয়াছে।
“এই প্রকারই মহারাজ! বর্ষের গণনা। সপ্ত, আমি সপ্ত নহি, কিন্তু আমার আশ্রয়েই (কারণেই) সপ্ত গণিত হয়, যেমন আপনার ছায়া।”
ভন্তে! বড়ই আশ্চর্য! বড়ই অদ্ভুত! আপনি জটিল প্রশ্ন প্রাঞ্জল ভাবে বুঝাইয়া দিলেন।

মীমাংসা প্রশ্ন

 ৬। রাজা বলিলেন- “ভন্তে নাগসেন! আপনি আমার সঙ্গে শাস্ত্ৰালোচনা করিবেন কি?"
মহারাজ! যদি আপনি পন্ডিতগণের ন্যায় আলোচনা করেন তবে অবশ্যই আলাপ করিব। আর যদি রাজাদের ন্যায় আলাপ করেন তবে করিব না।
ভন্তে নাগসেন! পন্ডিতেরা কিরূপে শাস্ত্ৰবিচার করেন?"
মহারাজ! পন্ডিতগণ শাস্ত্ৰবিচারে একে অন্যকে আবেষ্টিত করেন, আবার আবেষ্টনমুক্তও করেন। পরস্পরকে নিগ্রহও করেন, নিগ্রহের প্রতিকারও করেন। পরস্পরকে বিশ্বাসও করেন, খন্ডনও করেন। ইহাতে কিন্তু কেহ কোপিত হন না। মহারাজ! এই প্রকারেই পন্ডিতগণ  শাস্ত্রালাপ করেন।
ভন্তে! রাজারা কি প্রকারে শাস্ত্রালাপ করেন?
মহারাজ! রাজারা আলাপ করিবার সময় একটি বিষয় মানিয়া লন। যিনি সেই বিষয়ের ব্যতিক্রম করেন তাহার দন্ডবিধান করেন- “ইহাকে এই দন্ড দাও।” মহারাজ! এই প্রকারেই রাজারা আলাপ করিয়া থাকেন।
| “ভন্তে! আমি পন্ডিতের ন্যায় আলাপ করিব, রাজার ন্যায় আলাপ করিব না। ভদন! বিশ্বস্তভাবে আলাপ করুন, যেমন কোন ভিক্ষু, শ্রামণের, উপাসক কিংবা আশ্রমবাসী সেবকের সাথে আপনার আলাপ হয় সেইরুপ বিশ্বস্তভাবে আমার সহিত আলাপ করু, ভয় করিবেন না।
আচ্ছা মহারাজ!” বলিয়া স্থবির স্বীকার করিলেন।
৭। রাজা বলিলেন- “ভন্তে! আমি জিজ্ঞাসা করিব?”
জিজ্ঞাসা করুন, মহারাজ!”
ভন্তে! আমি জিজ্ঞাসা করিয়াছি।
মহারাজ! আমিও উত্তর দিয়াছি।
ভন্তে! আপনি কি উত্তর দিয়াছেন?”
মহারাজ! আপনি কি জিজ্ঞাসা করিয়াছেন?"
তখন রাজা মিলিন্দের মনে এই চিন্তা হইল- “এই ভিক্ষু পন্ডিত, আমার সঙ্গে আলোচনা করিতে সমর্থ। আমার অনেক বিষয় জিজ্ঞাস্য আছে, এখন জিজ্ঞাসা করিলে হয়তঃ সেই সকল শেষ না হইতেই সূর্য অস্ত যাইতে পারে। সুতরাং আগামীকাল রাজপ্রাসাদে আলোচনা করিলেই ভাল হয়।
রাজা দেবমন্তিয়কে কহিলেন- “দেবমন্তিয়! তুমি ভদন্তকে বল- আগামীকাল রাজপ্রাসাদে রাজার সহিত আলোচনা হইবে।
এই বলিয়া রাজা মিলিন্দ আসন হইতে উঠিয়া স্থবির নাগসেন হইতে বিদায় লইলেন এবং রথে আরোহণ করিয়ানাগসেন, নাগসেনআবৃত্তি করিতে করিতে প্রস্থান করিলেন।
তখন, দেবমন্তিয় আয়ুষ্মান নাগসেনকে কহিলেনভন্তে! রাজা মিলিন্দের অভিপ্রায় যে আগামীকল্য রাজাপ্রাসাদেই রাজার সহিত আলোচনা হউক।
আচ্ছাবলিয়া স্থবির অনুমোদন করিলেন।
৯। তৎপর সেই রাত্রি প্রভাত হইলে দেবমন্তিয়, অনন্তকায়, মংকুর সর্বদিন্ন রাজার নিকট উপস্থিত হইয়া কহিলেন- “মহারাজ ! ভদন্ত নাগসেন আসিবেন কি?”
হাঁ, আসুন।
কতজন ভিক্ষুর সহিত আসিবেন?”
যতজন ভিক্ষু ইচ্ছা করেন তিনি ততজন ভিক্ষুর সহিত আসুন।
তখন সর্বদিন্ন কহিলেন- “মহারাজ! দশজন ভিক্ষুর সহিত আসুন!”
 দ্বিতীয়বারও রাজা বলিলেন- “তিনি যতজন ভিক্ষু ইচ্ছা করেন, ততজন ভিক্ষর সহিত আসুন।সর্বদিন্ন আবার বলিলেন- “মহারাজ! তিনি দশজন ভিক্ষর সহিত আসুন!” রাজা কহিলেন- "তাহার অভ্যর্থনার সর্ববিধ উপকরণ সজ্জিত। আমি বলিতেছি-তিনি যতজন ভিক্ষু ইচ্ছা করেন ততজন ভিক্ষুর সহিত আসুন। ওহে, এই সবদিন্ন অন্যথা বলিতেছে, কেন আমরা কি ভিক্ষুদিগকে ভোজন দিতে অসমর্থ?” এইরূপ কথিত হইলে সর্বদিন্ন নীরব হইলেন।
১০। তখন, দেবমন্তিয়, অনন্তকায় এবং মংকুর আয়ুস্মান নাগসেনের নিকট উপস্থিত হইয়া কহিলেন- “ভন্তে! রাজা মিলিন্দ বলিতেছেন যে আপনি যতজন ভিক্ষু ইচ্ছা করেন ততজন ভিক্ষুর সহিত আগমন করুন।

---#চলমান।
পরবর্তী পর্ব পড়ার জন্য আমাদের সাথে থাকুন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

buttons=(Accept !) days=(20)

আমাদের ওয়েবসাইট আপনার অভিজ্ঞতা উন্নত করতে কুকিজ ব্যবহার করে। দয়া করে সম্মতি দিন। Learn More
Accept !