দ্বিতীয় বর্গ
ধর্মসন্তুতি (বস্তুর অস্তিত্ব প্রবাহ)
২৫ । রাজা
বলিলেন- “ভন্তে নাগসেন! যে উৎপন্ন হয়,
সে কি যাহার মৃত্যু
হয় ঠিক সে-ই,
অথবা অন্য?”
স্থবির কহিলেন- “ঠিক সে- ও
নয়, আবার অন্যও নয়।”
“উপমা দ্বারা বুঝাইয়া
দিন।"
“মহারাজ! আপনি কি মনে
করেন যে আপনি অতি
তরুণ, ছোট্ট শিশু ছিলেন, শয্যায়
চিৎ হইয়া শুইয়া থাকিতেন, আর এখন এত
বড় হইয়াও সেই আপনিই কি
আছেন?"
“না, ভন্তে! সেই
উত্তানশায়ী শিশু অন্য ছিল,
আর বর্তমানে বৃহৎ আমি অন্য।"
“মহারাজ! যদি তাহা হয়
তবে মাতাও কেহ হইবে না,
পিতাও কেহ হইবে না,
আচার্যও কেহ হইবে না,
শিল্পীও কেহ হইবে না,
শীলবানও কেহ হইবে না
এবং প্রজ্ঞাবানও কেহ হইবে না।
আপনি কি মনে করেন
মহারাজ! কললের মাতা অন্য, অর্বুদের
মাতা অন্য, পেশির মাতা অন্য ঘণের
মাতা অন্য, ক্ষুদ্রকের মাতা অন্য, মহতের
মাতা অন্য, অন্যজন শিল্প শিক্ষা করে, অন্যজন শিক্ষিত
হয়, অন্য ব্যক্তি পাপকর্ম
করে, অন্য ব্যক্তির হস্ত-পদ ছিন্ন হয়?”
“ না, ভন্তে! কিন্তু
এইরূপ জিজ্ঞাসিত হইলে আপনি কি
উত্তর দিবেন?”
স্থবির কহিলেন- “মহারাজ! আমিই . . . . . . . সেই উত্তানশায়ী শিশু
ছিলাম, আমিই বর্তমানে বয়স্ক
হইয়াছি, সেই সকল বিভিন্ন
অবস্থা এই দেহকে আশ্রয়
করিয়াই একরূপে সংগৃহীত হইয়াছে।”
“আরও উপমা প্রদান
করুন।”
“যেমন, মহারাজ! যদি কোন লোক
প্রদীপ জ্বালে, তবে তাহা সারা
রাত্রি জ্বলিতে থাকিবে?”
“হাঁ, ভন্তে! তাহা
সারা রাত্রি জুলিতে কিবে।”
“মহারাজ! প্রথম যামে যে শিখা,
মধ্যম যামেও সেই শিখা?”
“না, ভান্তে।”
“মহারাজ! মধ্যম যামে যে শিখা,
শেষ যামেও কি সেই শিখা?”
“না, ভন্তে!”
“তবে কি মহারাজ!
পূর্ব যামে অন্য প্রদীপ,
মধ্যম যামে অন্য প্রদীপ,
শেষ
যামে অন্য প্রদীপ ছিল?”
“না, ভন্তে! পূর্ব
যামের প্রদীপকে আশ্রয় করিয়াই সারা রাত্রি প্রদীপ
প্রজ্বলিত ছিল।”
“মহারাজ! এই রূপেই ধর্ম-সন্ততি (অস্তিত্বের ধারা) প্রবাহিত হয়- একটি (অবস্থা)
উৎপন্ন হয় , অন্যটি বিনষ্ট হয়- অপূর্বাপরের ন্যায়
(যেন এক সঙ্গে) এই
প্রবাহ চলিতে থাকে। তজ্জন্য (যে জন্ম গ্রহণ
করে) সে- সেও নহে,
আর অন্যও নহে। পূর্ব জন্মের
অন্তিম বিজ্ঞানের (চ্যুতি চিত্তের) লয় হওয়ার সঙ্গেই
পরবর্তী জন্মের প্রথম বিজ্ঞান (প্রতিসন্ধি চিত্ত) উদয় হয়, সম্মিলিত
হয়।”
“আরও উপমা প্রদান
করুন।”
“মহারাজ! দুগ্ধ দোহনের পর সময়ান্তরে দধিতে
পরিণত হইতে পারে। দধি
হইতে মাখন, মাখন হইতে ঘূতে
পরিবর্তিত হয়। তখন যদি
কেহ এইরূপ বলে- যাহা দুধ,
তাহাই দধি তাহাই মাখন,
যাহা মাখন তাহাই ঘৃত,
তবে কি মহারাজ! সে
ঠিক কথাই বলে?
“না, ভন্তে! কেননা
দুধকে আশ্রয় করিয়াই সেই সকল সম্ভত
হইয়াছে।”
“এই রূপেই মহারাজ!
কোন বস্তুর অস্তিত্ব প্রবাহে এক অবস্থা উৎপন্ন
হয়, এক লয় হয়–
এই প্রকারে প্রবাহ চলিতে থাকে। এই কারণে যে
মরে, জন্মগ্রহণের পর সেও থাকে
না এবং অপরও হয়
না। এক জনের অন্তিম
বিজ্ঞান লয় হওয়ার সঙ্গে
সঙ্গেই অন্য জনের প্রথম
বিজ্ঞান উৎপন্ন হইয়া থাকে।”
“ভন্তে, নাগসেন! আপনি দক্ষ।”
পুনর্জন্ম সম্বন্ধে জ্ঞান
২৬| রাজা বলিলেন-
“ভন্তে নাগসেন! যে পুনর্জন্ম গ্রহণ
করে না সে কি
জানিতে পারে- “আমি পুনর্জন্ম গ্রহণ
করিব না?”
“হাঁ, মহারাজ! সে
তাহা জানিতে পারে- “আমি পুনর্জন্ম গ্রহণ
করিব না।”
“ভন্তে! সে কি প্রকারে
এ বিষয় জানিতে পারে?”
“মহারাজ! পুনরায় জন্মগ্রহণের যাহাও হেতু ও প্রত্যয়
(কারণ) তাহাদের উপশম হইলেই সে
জানিতে পারে- ‘আমি আর জন্মগ্রহণ
করিব ন'।”
“উপমা প্রদান করুন।”
“যেমন, মহারাজ! যদি কোন কৃষক-গৃহপতি (ক্ষেত্র) কর্ষন ও বীজ বপন
করিয়া ধান্যাগার পূর্ণ করে, তৎপর অন্য
সময় সে কৰ্ষন-বপন
করে না, যথা সঞ্চিত
ধান্যরাশি বসিয়া ভোগ করে , বিতরণ
করে কিংবা নিজের প্রয়োজনানুসারে খরচ করে, তবে
কি মহারাজ! সে জানিতে পারে
না যে, তাহার ধানাগার
আর পূর্ণ হইবে না।?”
“হাঁ, ভন্তে! সে
নিশ্চয় জানিতে পারে।”
“কি প্রকারে জানিবে?"
“ধান্যাগার পরিপূর্ণের যাহা হেতু, যাহা
প্রত্যয়, তাহাদের উপশম সে জানিতে
পারে আমার ধান্যাগার আর
পরিপূর্ণ হইবে না।”
“মহারাজ! এই প্রকার, পুনরায়
জন্মগ্রহণ করিবার যে সকল হেত
প্রত্যয় আছে সেই সকল
নষ্ট হইলেই সে জানিতে পারে
আমি আর পু গ্রহণ
করিব না।”
“ভন্তে নাগসেন, আপনি দক্ষ।”
জ্ঞান এবং প্রজ্ঞার স্বরূপ ও উদ্দেশ্য
২৭ । রাজা
বলিলে- “ভন্তে নাগসেন! যাহার জ্ঞান উৎপন্ন হয়, তাহার প্রজ্ঞা
উৎপন্ন হয় কি?”
“হাঁ, মহারাজ! যাহার
জ্ঞান উৎপন্ন হয়, তাহার প্রজ্ঞাও
উৎপন্ন হয়।”
“ভন্তে! যাহা জ্ঞান তাহাই
কি প্রজ্ঞা?"
“হাঁ, মহারাজ! জ্ঞান
ও প্রজ্ঞা একই বস্তু।”
“ভন্তে! যদি তাহা হয়
তবে তাহার কোন বিষয়ে মোহ
থাকে কি?”
“মহারাজ! কোন বিষয়ে তাহার
মোহ থাকে আর কোন
বিষয়ে থাকে না।”
“ভন্তে! কোন্ বিষয়ে মোহ
থাকে আর কোন্ বিষয়ে
থাকে না?”
“মহারাজ! সে যে বিদ্যা
শিক্ষা করে নাই, যে
দেশে যায় নাই এবং
যে বিষয়ে শোনে নাই, সেই সকল
বিষয়ে তাহার মোহ থাকে।”
“আর কোন্ বিষয়ে
তাহার মোহ থাকে না?”|
“মহারাজ! স্বীয় প্রজ্ঞা দ্বারা সে যেই অনিত্য,
দুঃখ ও অনাত্মা সম্বন্ধে
জানিয়াছে, উহাতে তাহার কোন মোহ থাকিবে
না?”
“ভন্তে! এই সকল বিষয়ে
তাহার কোন মোহ থাকিবে
না।”
“মহারাজ! জ্ঞান উৎপন্ন হইবার সঙ্গেই এই সকল বিষয়ে
তাহার মোহ নিরুদ্ধ হয়।”
“উপমা প্রদান করুন।”
“যেমন মহারাজ! কোন
ব্যক্তি যদি অন্ধকার গৃহে
প্রদীপ স্থাপন করে তথা হইতে
অন্ধকার নিরুদ্ধ হয়, আলোক প্রাদুর্ভূত
হয়, এইরূপই মহারাজ! জ্ঞান উৎপন্ন হইয়া মাত্রই মোহ তথায়ই নিরুদ্ধ
হয়।”
“ভন্তে! উহার প্রজ্ঞা কোথায়
যায়?”
“মহারাজ! প্রজ্ঞাও স্বকৃত্য সম্পাদন করিয়া তথায় নিরুদ্ধ হয়, কিন্তু সেই
প্রজ্ঞা দ্বারা-সর্বদ্রব্য অনিত্য, সর্বদ্ৰব্য দুঃখময় এবং সর্বধর্ম অনাত্মরূপে-
যে বিবেক অর্জিত হইয়াছে তাহাই বিনষ্ট হয় না।”
২৮। “ভন্তে নাগসেন!
এখন যে বলিলেন প্রজ্ঞাও
স্বকৃত্য সম্পাদন করিয়া তথায় নিরুদ্ধ হয়, কিন্তু সেই
প্রজ্ঞা দ্বারা-সর্বদ্রব্য অনিত্য, সর্বদ্রব্য দুঃখময় এবং সর্বধর্ম অনাত্মরূপে-
যে বিবেক অর্জিত হইয়াছে তাহাই বিনষ্ট হয় না- তাহার
উপমা প্রদান করুন।”
“মহারাজ! যেমন কোন লোক
রাত্রিতে পত্র প্রেরণের ইচ্ছায়
লেখককে আহ্বান করিয়া, প্রদীপ জ্বালাইয়া পত্র লেখায় এবং
পত্র লিখিত হইলে প্রদীপ নির্বাপিত
করে, প্রদীপ নির্বাপিত হইলেও লিখিত লেখা বিনষ্ট হয়
না, মহারাজ! সেইরূপই প্রজ্ঞা স্বকৃত্য সম্পাদন করিয়া তথায় নিরুদ্ধ হয় এবং সেই
প্রজ্ঞাদ্বারা অনিত্য, দুঃখ কিংবা অনাত্মরূপে
যে ধারণা জন্মে উহা নষ্ট হয়
না।”
“আরও
উপমা প্রদান করুন।“
“যেমন মহারাজ! পূর্ব
দিকের জনপদসমূহে মানুষের রীতি ছিল যে।
অগ্নিনির্বাপনের জন্য প্রতি ঘরে
পঞ্চ পঞ্চ জলপূর্ণ ঘট
স্থাপন করিত। দৈবাৎ কাহারও ঘরে আগুন লাগিলে
সেই পঞ্চ জলপূর্ণ ঘট
ঘরের উপরে নিক্ষেপ করিত,
তাহাতে অগ্নি নির্বাপিত হইত। মহারাজ! সেই
সকল লোক আগুন নিভিয়া গেলে
কি এইরূপ চিন্তা করে যে পুনঃ
সেই ঘট দ্বারা অগ্নি
নির্বাপনের কাজ সম্পাদন করিব?”
“না, ভন্তে। সেই
ঘটের আর প্রয়োজন নাই।
তখন উহা দ্বারা কি
হইবে?”
“মহারাজ ! যেমন এই পঞ্চ
জলের ঘট, সেইরূপ পঞ্চ
ইন্দ্রিয়কে জানিতে হইবে - শ্রদ্ধেন্দ্রিয়, বীর্যেন্দ্রিয়, স্মৃতীন্দ্রিয়, সমাধীন্দ্রিয় ও প্রজ্ঞেন্দ্রিয়। যোগী
অগ্নি নির্বাপক মানুষের ন্যায়, ক্লেশসমূহকে অগ্নির ন্যায় জানিতে হইবে। যেমন পঞ্চ ঘটে
অগ্নি নির্বাপিত হয় সেইরূপ সেই
ক্ষেত্রে পাঞ্চেন্দ্রিয় দ্বারা ক্লেশসমূহ নির্বাপিত হয়। একবার নির্বাপিত
ক্লেশ আর পুনরুৎপন্ন হইতে
পারে না। মহারাজ! এইরূপেই
প্রজ্ঞা স্বকৃত্য সম্পাদন করিয়া নিরুদ্ধ হয়। কিন্তু সেই
প্রজ্ঞা দ্বারা অনিত্ , দুঃখ, অনাত্মা সম্বন্ধে যে ধারণা জন্মে
তাহা বিনষ্ট হয় না।”
“অনুগ্রহপূর্বক আরও উপমা প্রদান
করুন।”
“মহারাজ! কোন বৈদ্য পাঁচ
প্রকার শিকড় সংগ্রহ করিয়া রোগীর নিকট যায় এবং
উহা পিষিয়া ঔষধ প্রস্তুত করে
এবং সেই ঔষধ সেবন
করাইয়া রোগীকে আরোগ্যও করে। মহারাজ! রোগী
সুস্থ হইবার পরও কি বৈদ্য
এইরূপ ভাবিবে– “পুনরায় আমি ঐ শিকড়সমূহের
দ্বারা ভৈষজ্য- কৃত্য করিব?”
“না ভন্তে! তখন
ঐ শিকড়- গুচ্ছের আর কি প্রয়োজন?”
“মহারাজ! এক্ষেত্রে পঞ্চশিকড়ের ন্যায় পঞ্চেন্দ্রিয়কে জানিতে হইবে . . .। বৈদ্যের ন্যায়
রোগীকে জানিতে হইবে। ক্লেশসমূহকে রোগের ন্যায় জানিতে হইবে। প্রাকৃতজনকে রোগীর ন্যায় জানিতে হইবে। যেমন পঞ্চ মূল
ভৈষজ্য দ্বারা রোগের নিরাময় হয় সেইরূপ পঞ্চেন্দ্রিয়
দ্বারা ক্লেশসমূহ বিনষ্ট হয়। সেই বিনষ্ট
ক্লেশ আর উৎপন্ন হইতে
পারে না। . . . . মহারাজ! এই প্রকারেই প্জ্ঞা
স্বকৃত্য সম্পাদন করিয়া নিরুদ্ধ হয়।”
“আরও উপমা প্রদান
করুন।”
“মহারাজ! কোন সেনা পাঁচটি
শর লইয়া শত্রু জয়ের নিমিত্ত যুদ্ধক্ষেতে গমন করে।
সে পঞ্চশর নিক্ষেপ করিয়া শত্রুসৈন্যকে পরাজিত করে। মহারাজ! শত্রুরা
পরাজিত হইলেও সে পুনরায় সেই
শর নিক্ষেপ করিবে?”
“না, ভন্তে! শত্ৰু
পরাজিত হইলে তীর নিক্ষেপের
আর কি প্রয়োজন?”
“মহারাজ! পাঁচ শরের ন্যায় পঞ্চেন্দ্রিয়কে বুঝিতে হইবে। শত্রুর ন্যায় ক্লেশকে জানিতে হইবে। যেমন পঞ্চ শর দ্বারা শক্ত পরাজিত হয় সেইরূপ পঞ্চেন্দ্রিয় দ্বারা ক্লেশ বিনষ্ট হয়। একবার ক্লেশ বিনষ্ট হইলে পুনরায় উৎপন্ন হইতে পারে না। মহারাজ! এই প্রকারে প্রজ্ঞা স্বকৃত্য সম্পাদন করিয়া নিরুদ্ধ হয় . . . . .।”
---#চলমান।
পরবর্তী পর্ব পড়ার জন্য আমাদের সাথে থাকুন।
আমাদের কমেন্ট করার জন্য ধন্যবাদ। আমরা আপনার কমেন্ট পড়া মাত্র প্রতিক্রিয়া জানাতে চেষ্টা করবো।