অরহতের দুঃখ-সুখ-অনুভূতি প্রশ্ন
২৯ । রাজা
বলিলেন- “ভন্তে! যিনি পূনর্জন্ম গ্রহণ
করেন না, তিনি কিছু
দুঃখ-বেদনা অনুভব করেন কি?”
স্থবির কহিলেন- “কিছু অনুভব করেন,
কিছু করেন না।”
“কি অনুভব করেন,
আর কি করেন না?”
“কায়িক দুঃখ বেদনা অনুভব
করেন, মানসিক বেদনা অনুভব করেন|”
“ভন্তে! তাহা কি প্রকারে
হয়?”
“কায়িক দুঃখ-বেদনা উৎপত্তির
যে হেতু ও যে
প্রত্যয় তাহাদের উপশম না হওয়ার জন্য
তাহা তাঁহাকে অনুভব করিতে হয়। মানসিক দুঃখ-বেদনা উৎপত্তির যে হেতু ও
প্রত্যয় আছে তাহাদের উপশমের
জন্য তাহা তাহাকে অনুভব
করিতে হয় না “
“মহারাজ! ভগবান বলিয়াছেন- “তিনি একমাত্র কায়িক
বেদনা অনুভব করেন, মানসিক নহে ”
“মহারাজ! অরহতের কোন অনুযোগ কিংবা
বিদ্বেষ নাই। তাহারা অপক্ককে
বিনষ্ট করেন না, পন্ডিতগণ
পরিপক্কর অপেক্ষা করেন। মহারাজ ! ধর্ম-সেনাপতি সারিপুত্ৰও
ইহা বলিয়াছেন - - |
‘মরণের কামনা ও জীবনের প্রত্যাশা
আমার নাই। ভৃত্য যেমন
কার্যসম্পাদনের পর নিজের বেতনের
প্রতীক্ষা করে তদ্রপ আমি
নিজের সময়ের প্রতীক্ষা করিতেছি। মরণের কামনা ও জীবনের প্রত্যাশা
আমার নাই। জ্ঞানপূর্বক সতর্কতার
সহিত আমি নিজের সময়ের
প্রতীক্ষা করিতেছি।”
“ভন্তে
নাগসেন! আপনি দক্ষ।”
বেদনা
৩৫। রাজা বলিলেন-
“ভন্তে নাগসেন! সুখ-বেদনা কুশল
(পুণ্য), অকুশল (পাপ) কিংবা অব্যাকৃত
(অপাপ-অপুণ্য)?"
“মহারাজ! তিন প্রকারই হইতে
পারে।”
“ভন্তে! যদি উহা কুশল
হয় তবে দুঃখময় নহে
আর যদি দুঃখময় হয়
তবে উহা কুশল নহে;
কুশল দুঃখময়রূপে উৎপন্ন হইতেই পারে না।”
“মহারাজ! আপনি কি মনে
করেন, যদি কোন ব্যক্তি
নিজের এক হাতে তপ্ত
লৌহ গোলা রাখে অপর
হাতে ঠান্ডা এক বরফ খন্ড
রাখে তবে উভয়ে তাহাকে
কষ্ট দিবে?"
“হাঁ ভন্তে! উভয়ে
তাহাকে কষ্ট দিবে।”
“মহারাজ! কেন, উভয়ই কি
উষ্ণ?”
“না, ভান্তে।”
“তবে উভয়ই কি
ঠান্ডা?”
“না, ভান্তে।”
“তাহা হইলে মহারাজ!
এখন আপনি নিজের পরাজয়
স্বীকার করুন। যদি উষ্ণই কষ্ট
দেয় তবে তাহারা উভয়ে
উষ্ণ নহে, সুতরাং কষ্ট
না হওয়া উচিত; আর যদি শীতল
কষ্ট দেয় তবে তাহারা
উভয়ে শীতল নহে, কষ্ট
না হওয়া উচিত ছিল। মহারাজ,
তখন উভয়ে কি প্রকারে কষ্ট
দেয়- কেননা উভয়ে উষ্ণও নহে আর উভয়ে
শীতল ও নহে! যখন
এক উষ্ণ ও এক
শীতল তখন উভয়ে কষ্ট
দেয়, ইহা সম্ভব নহে।"
“ আপনার ন্যায় বাদীর সঙ্গে আলাপ করিতে আমি
সমর্থ নহি। সাধু, ভন্তে
, দয়া করিয়া আমাকে অর্থ কি বলুন।”
তখন স্থবির অভিধর্ম-
সংযুক্ত কথা দ্বারা রাজাকে
খুঝাইয়া দিলেন-
“মহারাজ! এই ছয় প্রকার
সাংসারিক জীবনের (মানসিক) সুখ, ছয় প্রকার
নিস্কাম জীবনের সূখ; ছয় প্রকার
সাংসারিক জীবনের দুঃখ; ছয় প্রকার নিষ্কাম
জীবনের দুঃখ; ছয় প্রকার সাংসারিক
জীবনের উপেক্ষা; আর ছয় প্রকার
নিষ্কাম জীবনের উপেক্ষা- সম্মিলিতভাবে এই ছয় ছক্কা
(ছত্রিশ) হয়।
এইভাবে অতীত কালের ছত্রিশ
বেদনা, ভবিষ্যত কালের ছত্রিশ বেদনা, আর বর্তমান কালের
ছত্রিশ প্রকার বেদনা- এই সমস্ত একস্থানে
সংযুক্ত ও পুঞ্জীভূত করিয়া
একশত আট প্রকার বেদনা
হয়।”
“ভন্তে নাগসেন! আপনি দক্ষ।”
নাম-রূপের একত্ব ও নানাত্ব
৩১। রাজা বলিলেন-
“ভন্তে নাগসেন! কে জন্মগ্রহণ করে?”
স্থবির কহিলেন- “মহারাজ! নাম ও রূপ
জন্মগ্রহণ করে।”
“এই নাম- রপই
কি জন্মগ্রহণ করে?”
“মহারাজ! এই নাম-রূপই
জন্মগ্রহণ করে না। মানুষ
এই নাম-রূপ দ্বারা
পাপ কিংবা পুণ্য কর্ম করে, সেই
কর্ম দ্বারা অপর নাম-রূপ
জন্মগ্রহণ করে।”
“ভত্তে! যদি এই নাম-রূপই জন্মগ্রহণ না
করে তবে সে পাপ-কর্ম হইতে মুক্ত
হইবে না কি?"
স্থবির কহিলেন- “মহারাজ! যেমন যদি পুনরায়
জন্মগ্রহণ না করে তবে
পাপ কর্ম হইতে মুক্ত
হইতে পারে। কিন্তু যেহেতু সে পুনরায় জন্মগ্রহণ
করে সেই কারণে পাপ
কর্ম হইতে মুক্ত নহে
”
“উপমা প্রদান করুন।”
“মহারাজ! যেমন কোন ব্যক্তি
অপর কাহারও আম চুরি করে।
আমের মালিক তাহাকে ধরিয়া রাজার নিকট লইয়া যায়
এবং বলে- 'দেব! এই ব্যক্তি
আমার আম চুরি করিয়াছে।”
ইহাতে চোর এইরূপ বলে-
“দেব! আমি তাহার আম
চুরি করি নাই। ইনি
এক আম রোপণ করিয়াছেন,
আর আমি অপর আম
লইয়াছি। সুতরাং আমার শান্তি হওয়া
অনুচিত।' -কেমন মহারাজ! এই
ব্যক্তি দন্ডনীয় হইবে কি না?”
“হাঁ, ভন্তে! দন্ডনীয়
হইবে।”
“কেন?”
“যদিও সে এইরূপ
বলে তথাপি ভন্তে! পূর্ব আম্র-সন্ততি বর্তমান
থাকায় পরবর্তী আম্র চুরির জন্য
সে ব্যক্তি দন্ডনীয় হইবে।"
“মহারাজ! এই রূপই মানুষ
এই নাম ও রূপ
দ্বারা পাপ কিংবা পূণ্য
কর্ম করে। সেই কর্মদ্বারা
অন্য নাম-রূপ পুনর্জন্ম
গ্রহণ করে। এই কারণে
সে আপন কর্ম হইতে
মুক্ত নহে।”
“পুনরায় উপমা প্রদান করুন।”
“মহারাজ! যেমন কোন ব্যক্তি
অপর কাহারও ধান্য কিংবা ইক্ষু চুরি করে এবং
ধরিয়া আনিলে অম্ৰচোরের ন্যায় বলে . . . . . ।
মহারাজ! যেমন কোন ব্যক্তি
শীতকালে অগ্নি জ্বালাইয়া তাপ লইল এবং
উহা না নিবাইয়া চলিয়া
গেল। তৎপর সেই অগ্নি
অন্য লোকের ক্ষেত্র দগ্ধ করিল। তখন
ক্ষেত্র স্বামী তাহাকে ধরিয়া রাজার নিকট আনে এবং
বলে- “রাজন্! এই ব্যক্তি আমার
ক্ষেত্র প্রজ্বলিত করিয়াছে।' সে এইরূপ বলে-
“দেব! আমি ইহার ক্ষেত্র
প্রজ্বলিত করি নাই। আমি
যাহা নির্বাপিত করি নাই তাহা
এক অগ্নি, আর যাহা ইহার
ক্ষেত্র প্রজ্বলিত করিয়াছে উহা অপর অগ্নি।
সুতরাং আমি দন্ডার্হ নহি।"
এখন মহারাজ! আপনি বলুন উহার
শাস্তি হওয়া উচিত কিনা "
“হাঁ ভন্তে! শাস্তি
হওয়া উচিত।”
“কেন?"
“যদিও সে এইরূপ
বলে তথাপি ভন্তে! পূর্বের অগ্নি-প্রবাহ অবিচ্ছিন্ন থাকায় পরবর্তী অগ্নির জন্য সে দন্ডার্হ
হইবে।”
“মহারাজ! এইরূপই মানুষ এই নাম-রূপ
দ্বারা পাপ কিংবা পুণ্য
কর্ম করে . . .।”
“আরও উপমা প্রদান
করুন।”
“মহারাজ! যেমন কোন ব্যক্তি
প্রদীপ লইয়া স্বীয় প্রাসাদের ছাদে উঠে এবং
তথায় ভোজন করে। সেই
প্রদীপ জ্বলিতে জ্বলিতে কোন তৃণ দগ্ধ
করিল। তৃণ জ্বলিতে জ্বলিতে
কোন গৃহ দগ্ধ করিল।
গৃহ জ্বলিয়া সমগ্র গ্রাম দগ্ধ করিল। গ্রামবাসীরা
সেই ব্যক্তিকে ধরিয়া কহিল- “তুমি কেন গ্রামে
আগুন জ্বালাইয়া দিলে?" ইহাতে সে বলিল— “আমি
গ্রামে আগুন জ্বালাইয়া দিই
নাই। আমি যে আলোতে
ভোজন করিয়াছি সেই প্রদীপাগ্নি ছিল
এক, আর যে অগ্নিতে
গ্রাম জ্বলিয়াছে তাহা অন্য।' মহারাজ!
এই প্রকারে বিবদমান উভয় পক্ষ আপনার
নিকট উপস্থিত হইলে আপনি কাহার
দিকে রায় দিবেন?”
“ভন্তে! গ্রামবাসীর দিকে।”
“যদিও সে এইরূপ
বলে তথাপি তাহা (প্ৰদীপাগ্নি) হইতে এই অগ্নি
প্রজ্বলিত হইয়াছে।”
“মহারাজ! এই প্রকারেই, যদিও
মরণের সময় এক নাম-রূপ বিনষ্ট হয়
এবং জন্ম গ্রহণের সময়
অন্য নাম-রূপ উৎপন্ন
হয়, কিন্তু পূর্ব নাম-রূপ হইতে
পরবর্তী নাম-রূপ উৎপন্ন
হইয়াছে। সেই কারণে সে
স্বীয় কর্ম হইতে মুক্ত
নহে।”
“আরও উপমা প্রদান
করুন।”
“মহারাজ! যেমন কোন ব্যক্তি
একটি ছোট বালিকাকে বিবাহের
প্রস্তাব দিয়া তাহার জন্য টাকা দিয়া
কোন দূর দেশে চলিয়া
গিয়াছে। কিছু দিন পর
সেই বালিকা বড় হইয়া যুবতী
হইয়াছে। তখন অপর এক
ব্যক্তি পণ দিয়া তাহাকে
বিবাহ করে। অতঃপর প্রথম
ব্যক্তি আসিয়া বলে- “কেন তুমি আমার
স্ত্রীকে লইয়া যাইতেছ? সে এই উত্তর
করিল- “আমি তোমার স্ত্রীকে
নিতেছি না। তুমি যাহাকে
পণ দিয়া বিবাহের প্রস্তাব দিয়াছিলে সে ছোট বালিকা
ছিল। যাহাকে পণ দিয়া আমি
বিবাহ করিয়াছি সে বয়স্ক, যুবতী
নারী। মহারাজ! এখন যদি দুইজনে
বিবাহ করিয়া আপনার নিকট আসে তবে আপনি
কোন দিকে রায় দিবেন?"
“ভস্তে! প্রথম ব্যক্তির দিকে।”
“কেন?”
“যদিও সে এরূপ
বলে তথাপি সেই বালিকাই ত
বড় হইয়া যুবতী হইয়াছে।”
“মহারাজ! এই প্রকারে যদিও
মরণের সময় এক নাম-রূপ বিনষ্ট হয়।
এই কারণে স্বীয় কর্ম হইতে মুক্ত
হয় না।”
“আরও উপমা প্রদান
করুন।”
“মহারাজ! যেমন কোন ব্যক্তি
এক গোয়ালা হইতে এক কলস
দুগ্ধ ক্রয় করিল এবং আগামী
কাল লইয়া যাইব’ বলিয়া গোয়ালার কাছে রাখিয়া চলিয়া
গেল। সেই দুগ্ধ পরের
দিন দধিতে পরিণত হইল। পরের দিন
সেই ব্যক্তি আসিয়া গোয়ালাকে বলিল- “আমার দুধের কলস
দাও।' গোয়ালা সেই দধি তাহাকে
দেখাইল। সে কহিল- ‘আমি
তোমা হইতে দধি ক্রয়
করি নাই, আমার দুধের
কলস দাও।" গোয়ালা বলিল- “আমার অজ্ঞাতসারেই ঐ
দুগ্ধ স্বয়ং দধি হইয়া গিয়াছে।'
মহারাজ! এই প্রকারে বিবদমান
দুই জন আপনার নিকট
আসিলে আপনি কাহার দিকে
রায় দিবেন?"
“ভন্তে! গোয়ালার দিকে।”
“কেন?"
“যদিও সে এইরূপ
বলে তথাপি সেই দুগ্ধ হইতেই
দধি জন্মিয়াছে।”
“মহারাজ! এই প্রকারেই যদিও
মরণের সময় এক নাম-রূপ বিনষ্ট হয়
. . . । এই কারণে সে স্বীয় কর্ম
হইতে মুক্ত হয় না।”
“ভন্তে নাগসেন! আপনি দক্ষ।”
নাগসেনের পুনর্জন্ম
৩২।
রাজা বলিলেন- “ভন্তে! আপনি পুনরায় জন্মগ্রহণ
করিবেন কি?”
“মহারাজ! আমি পূর্বেই বলিয়া
দিয়াছি যে যদি সাংসারিক
আসক্তি থাকে তবে জন্মগ্রহণ
করিব, না থাকিলে করিব
না।”
“উপমা প্রদান করুন।”
"মহারাজ! কোন লোক রাজার
সন্তোষজনক কাজ করিল। রাজা
তাহাতে সন্তুষ্ট হইয়া তাহাকে উচ্চ পদে নিয়োগ
করিলেন। সে উচ্চপদ লাভ
করিয়া পঞ্চ কামগুণযুক্ত হইয়া
ভোগ-বিলাসে কাটাইতে লাগিল। যদি সে জনসাধারণকে
বলে- ‘রাজা আমার কোন
উপকার করিলেন না, তবে কি
সে ন্যায্যবাদী হইবে?”
“না, ভন্তে!“
মহারাজ! এই প্রশ্নের উদ্দেশ্য
কি? আমি ত পূর্বেই
বলিয়াছি যে যদি সাংসারিক
আসক্তি থাকে তবে জন্মগ্রহণ
করিব, না থাকিলে করিব
না।”
“তন্তে, নাগসেন! আপনি দক্ষ।”
---#চলমান।
---#চলমান।
পরবর্তী পর্ব পড়ার জন্য আমাদের সাথে থাকুন।
আমাদের কমেন্ট করার জন্য ধন্যবাদ। আমরা আপনার কমেন্ট পড়া মাত্র প্রতিক্রিয়া জানাতে চেষ্টা করবো।