মেণ্ডক প্রশ্নারম্ভ
বুদ্ধপূজা সুফল
১১। অতঃপর রাজা মিলিন্দ আয়ুষ্মান নাগসেন হইতে অবকাশ প্রাপ্ত হইয়া তাঁহার চরণে নতশিরে প্রণাম করিলেন এবং বলিলেন, “ভন্তে নাগসেন! অন্য ধর্মাবলম্বীরা এইরূপ বলেন,‘যদি বুদ্ধ স্বয়ং পূজা গ্রহণ করেন তবে তিনি পরিনির্বাণ লাভ করেন নাই। এখনও নিশ্চয়ই তিনি এই সংসারের সহিত সংযুক্ত, ভবের অন্তর্গত, সাধারণ মানুষের ন্যায় জগতের কোথাও তিনি বিদ্যমান আছেন। সুতরাং তাঁহার উদ্দেশ্যে কৃত পূজা বন্ধ্যা ও নিষ্ফল হয়। আর যদি তিনি পরিনির্বাণ লাভ করিয়া থাকেন তবে এই সংসারের সহিত তিনি বিসংযুক্ত এবং সর্ববিধ ভব হইতে নিঃসারিত হইয়াছেন। সুতরাং তাঁহার পূজা নিষ্প্রয়োজন। পরিনির্বাপিত কিছু গ্রহণ করেন না; যিনি গ্রহণ করেন না তাঁহার উদ্দেশ্যে কৃত পূজা বন্ধ্য ও নিষ্ফল হয়।
এই প্রশ্ন (দ্বিবাহু সাঁড়াশির ন্যায়) উভয় কোটিক, ইহা সাধারণ লোকের জ্ঞানগম্য বিষয় নহে, মহাজ্ঞানীদেরই বিচার্য বিষয়। আপনি দয়া করিয়া এই দৃষ্টি জাল ছেদন করুন এবং উভয় কোটিক প্রশ্ন একদিকে স্থাপন করুন। আপনার নিকট এই প্রশ্ন উপস্থাপিত হইল। অন্য ধর্মাবলম্বীদের কুতর্ক নিগ্রহের জন্য ভবিষ্যতে জিন পুত্রগণকে চক্ষুদান করুন।”
স্থবির কহিলেন, “মহারাজ! ভগবান পরিনির্বাণ লাভ করিয়াছেন এবং তিনি পূজা গ্রহণ করেন না। বোধিমূলে বুদ্ধত্বলাভের সঙ্গেই তাঁহার সকল পরিগ্রহ পরিত্যক্ত হইয়াছে। এখন অনুপাদিশেষ নির্বাণধাতুতে পরিনির্বাপিত (সংসার হইতে সম্পূর্ণ নিঃসরিত) হইবার পর আর ইহার প্রশ্নই উঠিতে পারে না।
মহারাজ! ধর্মসেনাপতি সারিপুত্র স্থবির বলিয়াছেন-
’দেবতা এবং মানব দ্বারা পূজিত হইয়া সেই অসমসম
বুদ্ধগণ সেই সকল গ্রহণ কিংবা বর্জন করেন না, বুদ্ধগণের ইহাই ধর্মতা বা স্বভাব’
১২। রাজা বলিলেন, “ভন্তে নাগসেন! পুত্র পিতার প্রশংসা করেন, পিতা পুত্রের প্রশংসা করেন; পরপ্রবাদ নিগ্রহের নিমিত্ত উহা কোন প্রমাণ নহে। ইহাও তাঁহাদের স্ব-স্বমনের প্রসন্নতা প্রকাশ মাত্র। হাঁ, আপনি এখন ভ্রান্ত মতবাদ নিরসনকল্পে এবং স্বীয় সত্যধর্ম প্রতিষ্ঠা কল্পে এ বিষয়ে সম্যক্রূপে প্রমাণ প্রদর্শন করুন।”
স্থবির কহিলেন, “মহারাজ! ভগবান পরিনির্বাপিত হইয়াছেন। তিনি পূজা গ্রহণ করেন না। তথাগত পূজা গ্রহণ না করিলেও দেবতা ও মনুষ্যগণ তাঁহার শারীরিক (পুতাস্থি রূপ) ধাতু-রত্ন কে ভিত্তি করিয়া তাঁহার উপদিষ্ট জ্ঞানরত্নের অনুকূল আচরণ করিলে ত্রিবিধ (মনুষ্য, দিব্য ও মোক্ষ) সম্পত্তি লাভ করিয়া থাকেন।”
“মহারাজ! যদি কোন মহা অগ্নিস্কন্ধ
প্রজ্বলিত হইয়া নিভিয়া যায় তবে কি অগ্নিস্কন্ধ তৃণ-কাষ্ঠ প্রভৃতি ইন্ধন গ্রহণ করিবে?”
“না ভন্তে! প্রজ্বলিত অবস্থায়ও সেই অগ্নি তৃণ-কাষ্ঠ প্রভৃতি ইন্ধন গ্রহণ করে নাই। আর এখন নিভিয়া শান্ত ও নিস্তেজ হইবার পর কি করিয়া গ্রহণ করিবে?”
“মহারাজ! সেই বৃহৎ অগ্নিস্কন্ধ
নির্বাপিত হইলে জগৎ কি অগ্নিশূন্য হয়?”
“না, ভন্তে! শুষ্ক কাষ্ঠ অগ্নি উৎপত্তির স্থান ও উপাদান। যাহারা অগ্নি জ্বালাইতে ইচ্ছা করে তাহারা স্বীয় শক্তি, উদ্যোগ ও পুরুষকার দ্বারা কাষ্ঠ মন্থন করিয়া (অর্থাৎ কাষ্ঠে ঘর্ষণ করিয়া) অগ্নি উৎপাদন করে, এবং সেই অগ্নিদ্বারা
নিজের প্রয়োজনীয় কার্য সম্পাদন করে।”
“মহারাজ! তাহা হইলে অন্য মতাবলম্বীদের
এই বাক্য মিথ্যা প্রতিপন্ন হয় যে‘যিনি গ্রহণ করেন না তাঁহার উদ্দেশ্যে কৃতপূজা বন্ধ্যা ও নিষ্ফল হয়”।
মহারাজ! যেমন সেই বৃহৎ অগ্নি প্রজ্বলিত হইয়াছিল, সেইরূপ ভগবানও দশ সহস্র লোক চক্রবালে স্বীয় বুদ্ধতেজে প্রজ্বলিত হইয়াছিলেন। যেমন যেই বৃহৎ অগ্নি জ্বলিয়া নিভিয়া গিয়াছে, সেইরূপ ভগবানও অনুপাদিষেশ নির্বাণধাতুতে নির্বাপিত হইয়াছেন। যেমন অগ্নি নির্বাপিত হইয়া শীতল হইবার পর তৃণ-কাষ্ঠ প্রভৃতি ইন্ধন গ্রহণ করে না সেইরূপ লোকহিতার্থী বুদ্ধ কিছুই গ্রহণ করেন না। (যেমন) ইন্ধনহীন হইয়া অগ্নি নির্বাপিত হইলে মনুষ্যগণ স্বীয় শক্তি ও পুরুষকার দ্বারা শুষ্ক কাষ্ঠ মন্থন করিয়া অগ্নি উৎপাদন করে এবং নিজেদের প্রয়োজনীয় কার্য সম্পাদন করে, সেইরূপ দেবতা ও মানবগণ ভগবানের শারীরিক ধাতুরত্নকে ভিত্তি করিয়া তথাগতের উপদিষ্ট জ্ঞানরত্নের অনকুল আচরণ করিয়া ত্রিবিধ সম্পত্তি অধিকারী হয়। মহারাজ! এই কারণে পরিনির্বাপিত বুদ্ধ গ্রহণ না করিলেও তাঁহার প্রতি কৃত পূজা অবন্ধ্যা ও সফল হয়।”
১৩। “মহারাজ! অপর এক কারণও শ্রবণ করুন, যাহাতে পরিনির্বাণ প্রাপ্ত তথাগত গ্রহণ না করিলেও তাঁহার প্রতি কৃত পূজা-সৎকার অবন্ধ্যা ও সফল হয়-
মহারাজ! যদি এক প্রবল বায়ু প্রবাহিত হইয়া ধীরে ধীরে থামিয়া যায়, থামিয়া যাইবার পর সেই প্রশমিত বায়ু কি পুনরায় উৎপন্ন হইতে ইচ্ছা করে?”
“না, ভন্তে! উপশান্ত বায়ুর পুনরুৎপত্তির
ইচ্ছা আর হয় না। কারণ সেই বাযু
ধাতু অচেতন পদার্থ, ইহার কোন ইচ্ছা থাকে না।”
“মহারাজ! উপশান্ত বায়ুকে আর বায়ু নামে অভিহিত করা চলে না।?”
“তাহা নহে, ভন্তে! কারণ তালপত্র, পাখা প্রভৃতির দ্বারাও বায়ু উৎপন্ন হইতে পারে। যাহারা উষ্ণ তপ্ত হয়, পরিদাহে প্রপীড়িত হয় তাহারা তালপত্র কিংবা পাখার সাহয্যে নিজের শক্তি, উদ্যোগ ও পুরুষকার দ্বারা বায়ু উৎপাদন করিতে সমর্থ হয়। সেই বায়ুদ্বারা উষ্ণতাকে শীতল করে এবং দাহ উপশম করে।”
“মহারাজ তাহা হইলে ভিন্নমতাবলম্বীদের বাক্য মিথ্যা প্রতিপন্ন হয় যে‘যিনি গ্রহণ করেন না তাঁহার প্রতি কৃত্য পূজা বন্ধ্যা ও নিষ্ফল হয়’।
মহারাজ! যেমন মহাবায়ু প্রবাহিত হয় সেইরূপ ভগবানও শীতল---মৈত্রী বায়ুরূপে প্রবাহিত হইয়া সংসার হইতে সম্পূর্ণরূপে নির্বাপিত হইয়াছেন। যেমন উপশান্ত বায়ু পুনরুৎপত্তি ইচ্ছা করে না, সেইরূপ লোকহিতৈষী বুদ্ধের পরিগ্রহ পরিত্যক্ত ও উপশন্ত হইয়াছে। যেমন মানুষেরা উষ্ণতপ্ত ও দাহ প্রপীড়িত হয়, সেইরূপ দেব ও মানবগণ ত্রিবিধ (লোভ, দ্বেষ, মোহ) অগ্নি-সন্তাপ-পরিদাহ প্রপীড়িত হয়। যেমন তালপত্র, পাখা প্রভৃতি বায়ুর উৎপত্তির কারণ হয় সেইরূপ তথাগতের ধাতু ও জ্ঞান-রত্ন ত্রিবিধ সম্পত্তি লাভের হেতু হয়। যেমন মানুষেরা উষ্ণতপ্ত ও দাহ-পীড়িত হইয়া তালপত্র কিংবা পাখার সাহায্যে বায়ু উৎপাদন করিয়া উষ্ণতা শীতল করে ও দাহ উপশম করে, সেইরূপ পরিনির্বাপিত তথাগত গ্রহণ না করিলেও লোকেরা তাঁহার ধাতু ও জ্ঞান-রত্নকে পূজা করিয়া কুশল কর্ম সম্পাদন করিতে পারে এবং তৎদ্বারা ত্রিবিধ অগ্নি সন্তাপ নির্বাপণ করিতে সমর্থ হয়। মহারাজ! এই কারণেও পরিনির্বাণপ্রাপ্ত তথাগত গ্রহণ না করিলেও তাঁহার উদ্দেশ্যে কৃত সৎকার অবন্ধ্যা ও সফল হয়।”
১৪। “মহারাজ! পরবাদ নিগ্রহের নিমিত্ত অপর কারণ ও শ্রবণ করুন। মহারাজ! লোকে ভেরীতে প্রহার করিয়া শব্দ উৎপাদন করে। যদি মানুষের উৎপাদিত সেই ভেরী শব্দ অন্তর্হিত হয় তবে কি সেই অন্তর্হিত শব্দ পুরুৎপত্তির ইচ্ছা করে?”
“না, ভন্তে! সেই শব্দ অন্তর্হিত হইয়াছে। সেই অন্তর্হিত শব্দের পুনরুৎপত্তির
ইচ্ছা ও প্রবৃত্তি হয়। ভেরীর শব্দ একবার বাহির হইয়া অন্তর্হিত হইলে উহা সম্পূর্নরূপে লয় পায়। কিন্তু হ্যাঁ, ভেরী শব্দোৎপত্তির একটি কারণ (প্রত্যয়)। অতএব প্রয়োজন হইলে মানুষ স্বীয় উদ্যোগ দ্বারা ভেরী প্রহার করিয়া শব্দ উৎপাদন করে।”
“মহারাজ! তদ্রপ ভগবান শীল, সমাধি, প্রজ্ঞা, বিমুক্তি, বিমুক্তি-জ্ঞান দর্শনপরিভাবিত
শরীর ধাতুরূপ রত্ন, ধর্ম ও বিনয়ের অনুশাসনরূপ শাস্তাকে রাখিয়া স্বয়ং অনুপাদিশেষ নির্বাণে পরিনির্বাপিত হইয়াছেন। কিন্তু ভগবান পরিনির্বাপিত হইলেও ত্রিবিধ সম্পত্তি লাভ বন্ধ হয় নাই। সংসার দুঃখ-প্রপীড়িত সত্ত্বগণ (ত্রিবিধ) সম্পত্তি কামনা করিয়া ধাতু-রত্ন, ধর্ম ও বিনয়ের অনুশাসনকে উপলক্ষ করিয়া সেই সম্পত্তি লাভ করিতে পারেন। মহারাজ! এই কারণেও নির্বাণ প্রাপ্ত তথাগত গ্রহণ না করিলেও তাঁহার উদ্দেশ্যে কৃত সৎকার অবন্ধ্যা ও সফল হয়।”
“মহারাজ! ভগবান ভবিষ্যৎকালে
সম্ভাব্য ঘটনা পূর্বে দেখিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন ও বুঝাইয়াছেন-
“আনন্দ! তোমাদের কাহার ও মনে এই চিন্তা হইতে পারে, ধর্ম (শাস্তা হীন) শাসনকর্তা হীন হইয়াছে, এখন আমাদের কোন শাস্তা (শাসনকর্তা) নাই। আনন্দ! এইরূপ মনে করার কারণ নাই। আমি তোমাদের নিকট যেই ধর্ম উপদেশ দিয়াছি যেই বিনয় প্রতিষ্ঠা করিয়াছি, আমার অবর্তমানে উহাই তোমাদের শাস্তা (শাসনকর্তা) হইবে।”
অতএব “পরিনির্বাণ প্রাপ্ত তথাগত গ্রহণ করেন না, সুতরাং তাঁহার উদ্দেশ্য কৃত পূজা বন্ধ্যা ও নিষ্ফল হয়” ভিন্ন মতাবলম্বীদের এই বাক্য মিথ্যা, অভূত, অসত্য, অলীক, বিরুদ্ধ বিপরীত প্রতিপন্ন হয়; উহা দুঃখ দেয়, দুঃখবিপাক জন্মায় ও নরকে লইয়া যায়।”
১৫। “মহারাজ! অপর এক কারণ শ্রবণ করুন যাহাতে ভগবান বুদ্ধের পরিনির্বাণের
পর তিনি গ্রহণ না করিলেও তাঁহার উদ্দেশ্যে কৃত পূজা অবন্ধ্যা ও সফল হয়।
মহারাজ! এই মহাপৃথিবী কি ইচ্ছা করে যে সমস্ত বীজ ইহার মধ্যে সংবর্ধিত হোক?”
“না, ভন্তে!”
“মহারাজ! কি কারণে পৃথিবীর অনিচ্ছা সত্ত্বেও বীজগুলি তাহাতে অঙ্কুরিত হয়, দৃঢ়মূল ও জটায় প্রতিষ্ঠিত হয়, এবং স্কন্ধ, সার ও শাখা প্রশাখা বিস্তারিত হইয়া পুষ্প ও ফল ধারণ করে?”
“ভন্তে! পৃথিবী ইচ্ছা না করিলেও ইহা সেই সকল বীজের আধার হয়, অঙ্কুরিত ও বর্ধিত হইতে সাহায্য করে; সেই বীজগুলি উহাকে আশ্রয় করিয়া সেই সাহায্য দ্বারা অঙ্কুরিত হয়, দৃঢ়মূল ও যথায় প্রতিষ্ঠিত হয় এবং স্কন্ধ সার ও শাখা ও প্রশাখা বিস্তৃত হইয়া পুষ্প ও ফল ধারণ করে।”
“মহারাজ! তাহা হইলে ভিন্নমতাবলম্বীরা নিজেদের মতবাদে নিজেরাই নষ্ট, ক্ষতিগ্রস্ত ও মিথ্যা প্রমাণিত হইল, যদি তাহারা বলিয়া থাকেন যে তথাগত গ্রহণ না করিলে তাঁহার প্রতি কৃত পূজা বন্ধ্যা ও নিষ্ফল হয়। মহারাজ! মহাপৃথিবীর ন্যায় ভগবান অর্হৎ সম্যকসবুদ্ধ বুঝিতে হইবে। পৃথিবী যেমন কিছু ইচ্ছা (বা অনিচ্ছা) করে না, সেইরূপ তথাগত ও কিছু গ্রহণ করে না। সেই বীজ রাশি যেমন পৃথিবীর আশ্রয়ের অঙ্কুরিত হয়, দৃঢ়মূল ও জটায় প্রতিষ্ঠিত হয়, স্কন্ধ, সার ও শাখা প্রশাখায় বিস্তৃত হইয়া পুষ্প ও ফল ধারন করে, সেইরূপ দেব-মানবগণ পরিনির্বাপিত তথাগতের শারীরিক ধাতুরত্ন ও জ্ঞানরত্নের আশ্রয়ে দৃঢ় কুশলমূলে প্রতিষ্ঠিত হয়, সমাধিস্কন্ধ, ধর্মসার শীল শাখা বিস্তৃত হয়, এবং বিমুক্তি (আর্য মার্গ) রূপ পুষ্প ও শ্রামণ্য (আর্য ফল) রূপ ফল ধারণ করে। মহারাজ! এই কারণেও পরিনির্বাণ প্রাপ্ত তথাগত গ্রহণ না করিলেও তাঁহার উদ্দেশ্যে কৃত পূজা অবন্ধ্যা ও সফল হয়।”
১৬। “মহারাজ! আর এক কারণ শ্রবণ করুন যাহাতে ভগবান বুদ্ধের পরিনির্বাণের পর তিনি গ্রহণ না করিলেও তাঁহার উদ্দেশ্যে কৃত পূজা অবন্ধ্যা সফল হয়। মহারাজ, এই উট, গরু, গাধা, ছাগল, অন্যান্য পশু মনুষ্যগণ তাহাদের পেটের মধ্যে কৃমিকূলের উৎপত্তি ইচ্ছা করে কি?”
“না, ভন্তে!”
“মহারাজ! তবে কি কারণে ইচ্ছা না করিলেও তাহাদের পেটে কৃমিকূল উৎপন্ন হইয়া পুত্র-পৌত্রাদিক্রমে
বহু ও বিপুল সংখ্যায় পরিণত হয়?”
“ভন্তে! উহাদের পাপ কর্মের প্রাবল্যের দরুন অনিচ্ছায় ও সেই সত্বগণের উদরে কৃমিকূল উৎপন্ন হইয়া পুত্রপৌত্রাদিক্রমে বহুত্ব ও বিপুলতা প্রাপ্ত হয়।”
“মহারাজ! এইরূপেই ভগবান বুদ্ধের পরিনির্বাণের
পর তিনি গ্রহণ না করিলেও তাঁহার শারীরিক ধাতু ও জ্ঞানাবলম্বনের প্রাবল্যহেতু তথাগতের উদ্দেশ্যে কৃত পূজা ও সৎকার অবন্ধ্যা ও সফল হয়।”
১৭। মহারাজ! অপর এক কারণ শ্রবণ করুন যাহাতে ভগবান বুদ্ধের পরিনির্বাণের পর তিনি গ্রহণ না করিলেও তাঁহার উদ্দেশ্যে কৃত পূজা অবন্ধ্যা সফল হয়।
“মহারাজ! দেহে আটানব্বই প্রকার রোগ হউক মানুষেরা তাহা ইচ্ছা করে কি?”
“না, ভন্তে!”
“মহারাজ! ইচ্ছা না করিলেও সেই সব রোগ দেহে উৎপন্ন হয় কেন?”
“ভন্তে! কৃত দুশ্চরিতের দরুন।”
“মহারাজ! যদি পূর্বকৃত অকুশল কর্মের ফল এখানে ভোগ করিতে হয়, তাহা হইলে পূর্ব জন্মকৃত ও ইহজন্মকৃত কুশলাকুশল কর্ম অবন্ধ্যা ও সফল হয়। এই কারণেও পরিনির্বাপিত
তথাগত গ্রহণ না করিলেও তাঁহার উদ্দেশ্যে কৃত পূজা ও সৎকার অবন্ধ্যা ও সফল হয়।”
১৮। “মহারাজ! আপনি শুনিয়াছেন কি পূর্বে নন্দক নামে এক যক্ষ স্থবির সারিপুত্রকে আঘাত করিয়া পৃথিবীতে প্রবিষ্ট হইয়াছিল?”
“হাঁ, ভন্তে! শোনা যায় জগতে ইহায় প্রসিদ্ধ।”
“মহারাজ! স্থবির সারিপুত্র কি নন্দক যক্ষের পৃথিবীর প্রবেশ ইচ্ছা করিয়াছিলেন?”
“ভন্তে যদি দেবলোক সহ এই জগতের আমূল পরিবর্তন হয়, চন্দ্র ও সূর্য মাটিতে পতিত হয়, পর্বতরাজ সুমেরু বিক্ষিপ্ত হয়, তথাপি স্থবির সারিপুত্র অপরের দুঃখ কামনা করিবেন না। তাঁহার কারন কি? ভন্তে যে কারণে স্থবির সারিপুত্র ক্রুদ্ধ কিংবা হিংসুক হইতে পারেন সেই কারণ সমূহ তাঁহার সমুচ্ছিন্ন সমূহত হইয়াছে। হেতুর সমুচ্ছেদের দরুণ স্থবির সারিপুত্র হত্যাকারীর প্রতিও ক্রোধ উৎপাদন করিতে পারেন না।”
“মহারাজ! যদি স্থবির সারিপুত্র নন্দক যক্ষের পৃথিবী-গ্রাস ইচ্ছা না করেন তবে কি কারণে সে পৃথিবীতে প্রবেশ করিল?”
“ভন্তে! স্বীয় পাপ কর্মের দরুণ।”
“মহারাজ! যদি পাপ কর্মের প্রারম্ভের দরুণ নন্দক যক্ষ পৃথিবীতে প্রবিষ্ট হয়, ইচ্ছা না করিলেও কৃত অপরাধ অবন্ধ্যা ও সফল হয় তাহা হইলে পাপ কর্মের প্রাবল্যহেতু-ঈপ্সিত না হইলেও কৃত কর্ম অবন্ধ্যা ও সফল হয়। মহারাজ! এই কারণেও নির্বাণ প্রাপ্ত তথাগত গ্রহণ না করিলেও তাঁহার উদ্দেশ্যে কৃত সৎকার অবন্ধ্যা ও সফল হয়।”
১৯। “মহারাজ! আর কতলোক এই ভাবে পৃথিবীতে প্রবেশ করিয়াছে তাহাদের বিষয় আপনি শুনিয়াছেন কি?”
“হাঁ, ভন্তে! শুনিয়াছি।”
“আচ্ছা, মহারাজ! বলুন দেখি।”
“ভন্তে! (১) চিঞ্চা’ নামক যুবতী, (২) সুপ্রবুদ্ধ নামে শাক্য, (৩) স্থবির দেবদত্ত, (৪) নন্দক যক্ষ এবং (৫) নন্দ নামক যুবকÍশুনা যায় এই পাঁচজন জীবন্ত অবস্থায় পৃথিবীতে প্রবিষ্ট হইয়াছে।”
“মহারাজ! কাহার প্রতি অপরাধ করিয়াছে?”
“ভন্তে! ভগবান ও তাঁহার শিষ্যগণের প্রতি।”
“কেমন, মহারাজ! ভগবান ও তাঁহার শিষ্যগণ ইহাদের পৃথিবী প্রবেশ ইচ্ছা করিয়াছেন কি?”
“না, ভন্তে!”
“মহারাজ! ইহাতেই সিদ্ধ হয় যে ভগবান পরিনির্বাণপ্রাপ্ত হইয়া সংসার হইতে সম্পূর্ণ রূপে নিঃসারিত হইলেও এবং তিনি গ্রহণ না করিলেও তাঁহার প্রতি কৃত পূজা-সৎকার অবন্ধ্যা ও ফল প্রদ হয়।”
“ভন্তে নাগসেন আপনি এই জটিল প্রশ্নকে সহজবোধ্য করিলেন, রহস্য উদঘাটন করিলেন, গ্রন্থি ছেদন করিলেন, গভীরকে অগভীর করিলেন। অন্য মতাবলম্বীরা দমিত হইল। ভ্রান্ত ধারনার নিরসন হইল। কুতার্কিকগণ নিষ্প্রভ হইল। আপনি গণাচার্যদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রমাণিত হইলেন।”
আমাদের কমেন্ট করার জন্য ধন্যবাদ। আমরা আপনার কমেন্ট পড়া মাত্র প্রতিক্রিয়া জানাতে চেষ্টা করবো।