চুল্লকশ্রেষ্ঠী-জাতক।

শাস্তা রাজগৃহের নিকটবর্ত্তী জীবকাম্রবণে অবস্থান করিবার সময় স্থবির চুল্লপন্থকের সম্বন্ধে এই কথা বলিয়াছিলেন। রাজগৃহের কোন বিভবশালী শ্রেষ্ঠীকন্যা পিত্রালয়ে এক দাসের প্রণয়াসক্ত হইয়াছিল। কথা প্রকাশ পাইলে নির্য্যাতন ভোগ করিতে হইবে ভাবিয়া একদিন শ্রেষ্ঠীকন্যা তাহার প্রণয়ীকে বলিল, এখানে আর থাকা যায় না; মাতাপিতা এই গুপ্ত প্রণয়ের কথা জানিতে পারিলে আমাদিগকে খণ্ডবিখণ্ড করিয়া কাটিয়া ফেলিবেন। চল, এখন বিদেশে আত্মীয় বন্ধুদিগের আগোচরে কোথাও গিয়া বাস করি অনন্তর শ্রেষ্ঠীকন্যা একদিন রাত্রিকালে দাসের সহিত বস্ত্রালঙ্কারাদি হস্তে লইয়া প্রধান দ্বার দিয়া নিষ্ক্রান্ত হইল এবং বহুদূরবর্ত্তী কোন গ্রামে গিয়া অবস্থিতি করিতে লাগিল।

কিয়ৎকাল পরে শ্রেষ্ঠীকন্যা সসত্ত্বা হইল এবং প্রসবকাল আসন্ন জানিয়া একদিন তাহার স্বামীকে বলিল, দেখ, এরূপ নির্ব্বান্ধব স্থানে প্রসববেদনা উপস্থিত হইলে আমাদিগকে বড় অসুবিধায় পড়িতে হইবে; অতএব ভাগ্যে যাহাই হউক না কেন চল আমার পিত্রালয়ে ফিরিয়া যাই। তাহার স্বামী কিন্তু আজ না কাল করিয়া দিন কাটাইতে লাগিল। তখন শ্রেষ্ঠীকন্যা ভাবিল, এই মূর্খ দণ্ডের ভয়ে যাইতে চাহিতেছে না; আমার কিন্তু মাতাপিতাই পরমবন্ধু; যাউক বা না যাউক, আমাকে তাঁহাদের নিকট যাইতেই হইবে। অনন্তর সে একদিন স্বামীর অনুপস্থিতিকালে সমস্ত গৃহসামগ্রী যথাস্থানে সাজাইয়া রাখিল এবং পার্শ্বস্থ প্রতিবেশীকে আমি পিত্রালয়ে চলিলাম, এই কথা বলিয়া সে স্থান পরিত্যাগ করিল।

দাস গৃহে ফিরিয়া শুনিল তাহার পত্নী পিত্রালয়ে গিয়াছে। সে কাল বিলম্ব না করিয়া রুদ্ধশ্বাসে ছুটিয়া তাহার অনুসরণ করিতে লাগল এবং কিয়ৎক্ষণ পরে তাহার সমীপে উপনীত হইল। তন্মুহূর্ত্তেই শ্রেষ্ঠীকন্যার প্রসববেদনা উপস্থিত হইল; সে পথিমধ্যে এক পুত্র প্রসব করিল।
প্রসবকালে পিত্রালয়ে থাকিবার জন্যই শ্রেষ্ঠীকন্যা পতিগৃহ হইতে বাহির হইয়াছিল, কিন্তু পথিমধ্যে যখন প্রসব হইল, তখন সে দেখিল সেখানে যাওয়া অনাবশ্যক। সুতরাং তাহারা স্বস্থানে প্রতিগমন করিল। পুত্রটী পথে প্রসূত হইয়াছিল বলিয়া তাহারা তাহার পন্থক এই নাম রাখিল।
ইহার পর শ্রেষ্ঠীকন্যা আবার গর্ভধারণ করিল। প্রথমবারে যেরূপ ঘটিয়াছিল, এবারও ঠিক সেইরূপ ঘটিল এবং এবারও তাহারা নবজাত শিশুর পন্থকনাম রাখিল। তদবধি লোকে প্রথম পুত্রটীকে মহাপন্থক এবং দ্বিতীয় পুত্রটীকেচুল্লপন্থক বলিত।

পন্থকদ্বয় শুনিত অন্য বালকেরা কেহ খুড়া-জ্যাঠার, কেহ ঠাকুর মা-ঠাকুর দাদার কথা বলে। তাহারা একদিন জননীকে জিজ্ঞাসা করিল, মা, আমাদের কি ঠাকুর মা, ঠাকুর দাদা নাই? মাতা বলিল, আছেন বৈকি। তোমাদের ঠাকুর দাদা রাজগৃহের একজন বড় বণিক; তাঁহার অতুল ঐশ্বর্য্য। সেখানে তোমাদের আরও কত আপন লোক আছেন। বালকেরা বলিল, তবে আমরা সেখানে থাকি না কেন? মাতা পুত্রদ্বয়কে যথাসম্ভব কারণ বুঝাইয়া দিলেন; কিন্তু তাহারা প্রবোধ মানিল না; তাহারা রাজগৃহে যাইবার জন্য পুনঃ পুনঃ এরূপ ব্যগ্রতা প্রকাশ করিতে লাগিল যে শ্রেষ্ঠীকন্যা অগত্যা স্বামীকে বলিল, ছেলেরা আমাকে পাগল করিয়া তুলিয়াছে। চল, ইহাদিগকে মাতামহালয় দেখাইয়া আনি। বাপ-মা কি আমাদিগকে খাইয়া ফেলিবেন? ইহাদিগকে সেখানে লইয়া যাইতে আমার আপত্তি নাই; কিন্তু আমি তোমার মা-বাপের কাছে মুখ দেখাইতে পারিব না। তা নাই দেখাইলে। কোন না কোন উপায়ে ছেলেরা তাহাদের দাদা মহাশয়কে দেখিতে পাইলেই হইল।

অনন্তর তাহারা পুত্রদ্বয় সঙ্গে লইয়া রাজগৃহে গমন করিল এবং নগরদ্বারে একটা বাসা লইল। পরদিন শ্রেষ্ঠীকন্যা পুত্র দুইটীকে লইয়া মাতাপিতার নিকট নিজের আগমনবার্ত্তা জানাইল। তাঁহারা বলিলেনসংসারী লোকের নিকট পুত্রকন্যা পরম প্রীতির পাত্র; কিন্তু আমাদের কন্যা তাহার স্বামী এমন গুরুতর অপরাধ করিয়াছে, যে তাহাদের মুখ দর্শন করিতে নাই। এই ধন লও; ইহা লইয়া তাহারা যেখানে ইচ্ছা চলিয়া যাউক; তবে ছেলে দুইটীকে আমাদের কাছে রাখিয়া যাইতে পারে। শ্রেষ্ঠীকন্যা দূতদিগের হস্ত হইতে পিতৃপ্রেরিত ধন গ্রহণ করিল এবং তাহাদিগেরই সঙ্গে পুত্রদ্বয়কে পাঠাইয়া দিল। তদবধি এই বালক দুইটী মাতামহালয়ে প্রতিপালিত হইতে লাগিল।

চুল্লপন্থক তখন নিতান্ত শিশু। মহাপন্থক অপেক্ষাকৃত অধিকবয়স্ক বলিয়া সে মাতামহের সঙ্গে দশবলের নিকট ধর্ম্মকথা শুনিতে যাইত। প্রতিদিন ধর্ম্মকথা শুনিয়া তাহার মনে প্রব্রজ্যা গ্রহণের বাসনা জন্মিল এবং একদিন সে মাতামহকে বলিল, দাদা মহাশয়, যদি অনুমতি করেন, তাহা হইলে আমি প্রব্রজ্যা অবলম্বন করি। বৃদ্ধ বলিলেন, কি বলিলি, ভাই! সমস্ত জগৎ প্রব্রজ্যা লইলে আমার যে সুখ হইবে, তুই প্রব্রজ্যা লইলে তাহার শতগুণ সুখ হইবে। যদি পারিবি বুঝিস্, তবে স্বচ্ছন্দে প্রব্রজ্যা গ্রহণ কর। ইহা বলিয়া বৃদ্ধ তাহাকে শাস্তার নিকট লইয়া গেলেন।

বৃদ্ধকে দেখিয়া শাস্তা জিজ্ঞাসা করিলেন, মহাশ্রেষ্ঠীন, তোমার সেই দৌহিত্রটীকে সঙ্গে আনিয়াছ তোহাঁ ভগবন, তাহাকে সঙ্গে আনিয়াছি। সে আপনার নিকট প্রব্রজ্যা লইতে চায়।ইহা শুনিয়া শাস্তা একজন স্থবিরকে ডাকাইয়া বলিলেনএই বালককে প্রব্রজ্যা দান কর। স্থবির পঞ্চকর্ম্মস্থান আবৃত্তি করিয়া তাহাকে প্রব্রজ্যা দিলেন। সে যত্নসহকারে বহু বুদ্ধবচন শিক্ষা করিয়া যথাকালে উপসম্পন্ন হইয়া ধ্যান-ধারণার প্রভাবে ক্রমশঃ অর্হত্ত্ব পর্য্যন্ত লাভ করিল।
মহাপন্থক ধ্যানসুখ মার্গসুখ অনুভব করিয়া চিন্তা করিতে লাগিলেন, চুল্লপন্থককে ইহার আস্বাদ পাওয়াইতে হইবে। তখন তিনি মাতামহের নিকট গিয়া প্রার্থনা করিলেন, দাদা মহাশয়, অনুমতি দিন আমি চুল্লপন্থককে প্রব্রজ্যা দান করি। দাদা মহাশয় বলিলেন, স্বচ্ছন্দে দান কর; আমার কিছুমাত্র আপত্তি নাই। ইহা শুনিয়া মহাপন্থক চুল্লপন্থককে প্রব্রজ্যা দান করিলেন এবং দশশীল শিক্ষা দিলেন।
কিন্তু প্রব্রজ্যা লাভের পর চুল্লপন্থকের বুদ্ধির জড়তা প্রকাশ পাইল; সে ক্রমাগত চারি মাস চেষ্টা করিয়াও নিম্নলিখিত একটী মাত্র গাথা আয়ত্ত করিতে পারিল না :

অনাঘ্রাতগন্ধ যথা প্রফুল্ল কমল
প্রভাতে তড়াগবক্ষে করে টলমল;
কিংবা অন্তরীক্ষে যথা শোভার আকর
বিতরে সহস্ররশ্মি দেব দিবাকর;
সেই মত তথাগত ভবকর্ণধার;
উজলিছে দশদিক্ প্রভায় তাঁহার।

শুনা যায় সম্যকসম্বুদ্ধ কাশ্যপের সময় এই চুল্লপন্থক প্রব্রজ্যা গ্রহণপূর্ব্বক প্রজ্ঞাবান হইয়াছিলেন; কিন্তু একদিন কোন জড়বুদ্ধি ভিক্ষুকে ধর্ম্মশাস্ত্রে কিয়দংশ কণ্ঠস্থ করিতে দেখিয়া তাহাকে উপহাস করিয়াছিলেন এবং তন্নিবন্ধন ব্যক্তি এত লজ্জিত হইয়াছিল যে, অতঃপর সে কখনও উক্ত অংশ অভ্যাস করিতে সমর্থ হয় নাই। এই পাপে ইহজন্মে চুল্লপন্থক নিজেই এত জড়বুদ্ধি হইয়াছিল যে নূতন একটী পঙ্ক্তি শিখিতে গিয়া পূর্ব্বে যে পঙ্ক্তি শিখিয়াছে তাহা ভুলিয়া যাইত এবং চারি মাস চেষ্টা করিয়াও একটী মাত্র গাথা কণ্ঠগত করিতে পারে নাই।

চুল্লপন্থকের জড়তা দেখিয়া মহাপন্থক বলিল, ‘ভাই, তুমি বুদ্ধশাসনের অধিকারী নহ; তুমি যখন চারি মাসে একটী গাথা শিখিতে পারিলে না, তখন ভিক্ষুজীবনের চরমফল লাভ করা তোমার পক্ষে একান্তই অসম্ভব। তুমি বিহার হইতে চলিয়া যাও। কিন্তু চুল্লপন্থক বুদ্ধশাসনে এত অনুরক্ত হইয়াছিল যে, এইরূপে বিদূরিত হইয়াও সে পুনরায় গৃহস্থ-ধর্ম্ম অবলম্বন করিতে ইচ্ছা করিল না।

এই সময় মহাপন্থকের উপর ভিক্ষুদিগের খাদ্যবন্টন করিবার ভার ছিল। একদিন জীবক কৌমারভৃত্য আম্রকাননে গিয়া শাস্তাকে নানাবিধ গন্ধমাল্য উপহার দিলেন, ধর্ম্মোপদেশ শ্রবণপূর্ব্বক আসন ত্যাগ করিয়া শাস্তাকে প্রণাম করিয়া মহাপন্থকের নিকট গেলেন এবং জিজ্ঞাসা করিলেন, মহাশয়, আজ-কাল শাস্তার নিকট কতজন ভিক্ষু আছেন? মহাপন্থক বলিলেন, পাঁচ আগামীকল্য বুদ্ধপ্রমুখ এই পঞ্চশত ভিক্ষু লইয়া অনুগ্রহপূর্ব্বক আমার গৃহে আহার করিবেন কি? ইহাদের মধ্যে একজন ভিক্ষু বড় জড়মতি। সে ধর্ম্মপথে কিঞ্চিন্মাত্র অগ্রসর হইতে পারে নাই। অতএব তাহাকে ব্যতীত অপর সকলের জন্য আপনার নিমন্ত্রণ গ্রহণ করিলাম।

ইহা শুনিয়া চুল্লপন্থক ভাবিল, নিমন্ত্রণ গ্রহণ করিবার সময় দাদা আমায় বাদ দিলেন। ইহাতে বোধ হইতেছে তিনি আমার প্রতি সম্পূর্ণরূপে মমতাশূন্য হইয়াছেন। অতএব বুদ্ধশাসন লইয়া আমি কি করিবপুনর্ব্বার গৃহী হইয়া দানাদি পুণ্যকর্ম্মের অনুষ্ঠান করি গিয়া। অনন্তর পরদিন প্রত্যুষে সে পুনর্ব্বার গৃহী হইবার অভিপ্রায়ে কুটীর ত্যাগ করিতে উদ্যত হইল।

এদিকে রজনী প্রভাত হইবামাত্র শাস্তা জগতের কোথায় কি হইতেছে, সমস্ত অবলোকন করিতেছিলেন। চুল্লপন্থকের চেষ্টিত তাঁহার জ্ঞানগোচর হইল এবং সে কুটীর হইতে বাহির হইবার পূর্ব্বেই তিনি সেখানে উপস্থিত হইয়া তাহার দ্বারদেশে পদচারণ করিতে লাগিলেন। চুল্লপন্থক বাহির হইয়াই তাঁহাকে দেখিতে পাইল এবং প্রণিপাতপূর্ব্বক সম্মুখে দাঁড়াইল। শাস্তা জিজ্ঞাসিলেন, চুল্লপন্থক, তুমি এত ভোরে কোথায় যাইতেছ? দাদা আমাকে বিহার হইতে তাড়াইয়া দিয়াছেন, সেই জন্য যেখানে হয় পরিভ্রমণ করিয়া বেড়াইব স্থির করিয়াছি। চুল্লপন্থক, তুমি আমার নিকট প্রব্রজ্যা পাইয়াছ। তোমার দাদা যখন তোমায় তাড়াইয়া দিল, তখন তুমি আমার নিকট আসিলে না কেন? তুমি ফিরিয়া আইস; গৃহী হইয়া কি করিবে? এখন অবধি তুমি আমার নিকট থাকিবে। ইহা বলিয়া শাস্তা চুল্লপন্থককে লইয়া গন্ধকুটীরের দ্বারে উপবেশন করিলেন এবং স্বীয় প্রভাববলে একখণ্ড পরিশুদ্ধ বস্ত্র সৃষ্টি করিয়া উহা চুল্লপন্থকের হস্তে দিয়া বলিলেন, তুমি পূর্ব্বাস্যে উপবেশন কর এবং এই বস্ত্রখণ্ড হস্ত দ্বারা পরিমার্জন করিতে করিতে রজোহরণ, রজোহরণ মন্ত্র জপ করিতে থাক। অনন্তর শাস্তা যথাসময়ে ভিক্ষুসঙ্ঘপরিবৃত হইয়া জীবক-গৃহে গমনপূর্ব্বক নির্দ্দিষ্ট আসন গ্রহণ করিলেন।

এদিকে চুল্লপন্থক সেই বস্ত্রখণ্ড পরিমার্জ্জন করিতে করিতে সূর্য্যের দিকে বদ্ধদৃষ্টি হইয়ারজোহরণ, রজোহরণ মন্ত্র জপ আরম্ভ করিল। সে যতই জপ করিতে লাগিল, বস্ত্রখণ্ড ততই মলিন হইতে লাগিল। সে ভাবিল, এই মাত্র বস্ত্রখণ্ড অতি নির্ম্মল ছিল; কিন্তু আমার স্পর্শে ইহার স্বাভাবিক বিশুদ্ধতা বিনষ্ট হইল। ইহা এখন মলিন হইয়া গেল। অতএব দেখা যাইতেছে জগতে বিমিশ্র বস্তু মাত্রেই অনিত্য এইরূপ চিন্তাদ্বারা তাহার মনে ক্ষয় বিনাশের জ্ঞান জন্মিল এবং সে বিদর্শনা লাভ করিল। শাস্তা জীবকগৃহে থাকিয়াই জানিতে পারিলেন চুল্লপন্থকের বিদর্শনা-লাভ হইয়াছে; তখন দেহ হইতে নিজের একটী প্রভাময়ী প্রতিমূর্ত্তি বাহির করিয়া তদ্বারা তাহার সম্মুখে আবির্ভূত হইলেন এবং বলিতে লাগিলেন, ‘চুল্লপন্থক, এই বস্ত্রখণ্ড যে মলসংসর্গে কলুষিত হইয়াছে তাহা ভাবিয়া হতাশ হইও না। তোমার হৃদয়ে কাম ক্রোধাদি কত মল আছে, তুমি সেইগুলি বিদূরিত কর। অনন্তর তিনি এই গাথাগুলি পাঠ করিলেন :

ধূলি, স্বেদজল, মল বল যারে, প্রকৃত তা মল নয়;
কামরূপ মল হৃদয়ের সদা পবিত্রতা করে ক্ষয়।
যেজন যতনে এই কামমল মন হতে দূর করে,
পুণ্যাত্মা সেজন বিমল অন্তরে শুদ্ধিমার্গে সদা চরে।
ধূলি, স্বেদজল, মল বল যারে, প্রকৃত তা মল নয়;
ক্রোধরূপ মল হৃদয়ের সদা পবিত্রতা করে ক্ষয়।
যেজন যতনে এই ক্রোধমল মন হতে দূর করে,
পুণ্যাত্মা সেজন বিমল অন্তরে শুদ্ধিমার্গে সদা চরে।
ধূলি, স্বেদজল, মল বল যারে, প্রকৃত তা মল নয়;
মোহরূপ মল হৃদয়ের সদা পবিত্রতা করে ক্ষয়।
যেজন যতনে এই মোহমল মন হতে দূর করে,
পুণ্যাত্মা সেজন বিমল অন্তরে শুদ্ধিমার্গে সদা চরে।

এই গাথাগুলি শুনিয়া চুল্লপন্থক পিটকাদি সর্ব্বশাস্ত্রজ্ঞ হইলেন। প্রবাদ আছে তিনি কোন অতীত জন্মে রাজা ছিলেন এবং একদিন নগর প্রদক্ষিণ করিবার সময় এক খণ্ড পরিস্কৃত বস্ত্র দ্বারা কপালের ঘাম মুছিয়া ছিলেন। তাহাতে বস্ত্রখণ্ড মলিন হইয়া যায় দেখিয়া তিনি ভাবিয়াছিলেন, আমার অপবিত্র দেহস্পর্শেই এই শুদ্ধ বস্ত্রখানির স্বাভাবিক শুক্লতা বিনষ্ট হইল, অতএব জগতের সমস্ত যৌগিক পদার্থই অনিত্য। এইরূপে তাঁহার মনে অনিত্যত্ত্বজ্ঞান সঞ্চারিত হইয়াছিল এবং সেই জ্ঞানের ফলে এখন মন হইতে অপবিত্রতা দূর করিবামাত্র তাঁহার মুক্তির পথ প্রশস্ত হইল।

এখন দেখা যাউক জীবকের আলয়ে কি হইতেছিল। ভিক্ষুগণ সমবেত হইলে জীবক দশবলকে ভোজ্য দ্রব্য উৎসর্গ করিবার নিমিত্ত দক্ষিণাজলআনয়ন করিলেন, কিন্তু শাস্তা হাত দিয়া ভিক্ষাপাত্রের মুখ বন্ধ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, বিহারের সমস্ত ভিক্ষুই আসিয়াছে কিমহাপন্থক উত্তর দিলেন, সকলেই আসিয়াছেন; বিহারে কেহই নাই। শাস্তা বলিলেন, আছে বৈ কি; বিহারে এখনও অনেক ভিক্ষু আছে। ইহা শুনিয়া জীবক কৌমারভৃত্য বলিলেন, কে আছিস্রে এখানেএকবার দৌড়িয়া বিহারে গিয়া দ্যাখ, সেখানে কতজন ভিক্ষু আছেন।

এদিকে চুল্লপন্থক ধ্যানবলেই বুঝিতে পারিলেন যে মহাপন্থক বলিয়াছেন বিহারে কোন ভিক্ষু নাই। এই কথা যে সত্য নহে এবং বিহারে যে তখনও ভিক্ষু আছেন, ইহা দেখাইবার জন্য তিনি প্রত্যয়বলে সমস্ত আম্রকানন ভিক্ষুপূর্ণ করিয়া ফেলিলেন; তাঁহারা কেহ চীবর সীবন করিতেছেন, কেহ বস্ত্র রঞ্জিত করিতেছেন, কেহ বা ধর্ম্মশাস্ত্র আবৃত্তি করিতেছেন। এইরূপে সহস্র ভিক্ষুর আবির্ভাব হইলতাঁহারা এক একজন যেন এক এক কাজে ব্যস্ত এবং প্রত্যেকের আকার অপর সকলের আকার হইতে ভিন্ন। বিহারে এত ভিক্ষু দেখিয়া জীবকের ভৃত্য ফিরিয়া গিয়া বলিল, সমস্ত উদ্যান ভিক্ষুপূর্ণ। প্রকৃতপক্ষে কিন্তু, একাকী পন্থক চুল্ল সহস্র বিগ্রহ ধরি ছিলা সেই আম্রবণে আহ্বান প্রতীক্ষা করি।

শাস্তা ভৃত্যকে বলিলেন, তুমি আবার যাও; বল গিয়া যাঁহার নাম চুল্লপন্থক, শাস্তা তাঁহাকে লইয়া যাইতে বলিয়াছেন। ভৃত্য আম্রকাননে গিয়া এই কথা বলিল; অমনি সহস্র মুখ হইতে আমি চুল্লপন্থক, আমি চুল্লপন্থক এই বাক্য নির্গত হইল। তখন সে পুনরায় জীবকের গৃহে গিয়া বলিল, ভগবন, তাঁহারা সকলেই বলিলেন, আমি চুল্লপন্থক। শাস্তা বলিলেন, আচ্ছা, বাপু, তুমি আরও একবার যাও এবং সর্ব্বপ্রথম যে বলিবে আমি চুল্লপন্থক তাহার হাত ধরিয়া ফেল। তাহা করিলেই অন্য সকলেই অন্তর্দ্ধান হইবে। ভৃত্য আদেশ মত কার্য্য করিল এবং তৎক্ষণাৎ সেই মায়া-ভিক্ষুগণ অন্তর্হিত হইল।স্থবির চুল্লপন্থক তাহার সহিত জীবকের আলয়ে উপনীত হইলেন।

ভোজন শেষ হইলে শাস্তা বলিলেন, জীবক, তুমি চুল্লপন্থকের হস্ত হইতে ভিক্ষাপাত্র গ্রহণ কর; ইনিই অদ্য তোমার এই ভোজের অনুমোদন করিবেন। জীবক তাঁহাই করিলেন; অমনি চুল্লপন্থক সিংহনাদে সমস্ত ধর্ম্মশাস্ত্র আবৃত্তি করিতে করিতে অনুমোদনে প্রবৃত্ত হইলেন। ইহার পর শাস্তা আসন ত্যাগ করিয়া সঙ্ঘসহ বিহারে প্রতিগমন করিলেন, ভিক্ষুদিগের কাহার কি কর্ত্তব্য তাহা নির্দ্দেশপূর্ব্বক গন্ধকূটীরের দ্বারে দণ্ডায়মান হইয়া বুদ্ধোচিত গাম্ভীর্য্যের সহিত ধর্ম্মব্যাখ্যা করিলেন, কাহার কি কর্ম্মস্থান তাহা স্থির করিয়া দিলেন এবং অবশেষে গন্ধকুটীরে প্রবেশপূর্ব্বক দক্ষিণপার্শ্বে ভর দিয়া সিংহের ন্যায় শয়ন করিলেন।

সন্ধ্যার সময় ভিক্ষুগণ চতুর্দ্দিক হইতে ধর্ম্মসভায় সমবেত হইয়া শাস্তার গুণকীর্ত্তন আরম্ভ করিলেন, আসনস্থ ব্যক্তির চতুর্দ্দিকে রক্তকম্বলশাণী প্রলম্বিত করিলে তাহার যেমন শোভা বর্দ্ধিত হয়, ভিক্ষুদিগের গুণগানে শাস্তার মহিমাও যেন সেইরূপ উজ্জ্বলতর হইয়া উঠিল। তাঁহারা বলিতে লাগিলেনদেখ, মহাপন্থক চুল্লপন্থকের প্রবৃত্তি বুঝিতে পারেন নাই; চুল্লপন্থক চারিমাসে একটীমাত্র গাথা অভ্যাস করিতে পারেন নাই দেখিয়া তিনি সিদ্ধান্ত করিয়াছিলেন ইহার বুদ্ধি অতি স্থূল। সেই জন্য তিনি ইহাকে বিহার হইতে দূর করিবার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। কিন্তু সম্যকসম্বুদ্ধের অলৌকিক ধর্ম্মজ্ঞানপ্রভাবে এই জড়মতি ব্যক্তি এক দিনে আহারের আয়োজনে যতটুকু সময় লাগে তাহারই মধ্যে চতুর্ব্বিধ প্রতিসম্ভিদাসহ[57] অর্হত্ত্ব লাভ করিলেন। এখন তিনি সর্ব্বশাস্ত্র-পারদর্শী। অহো! বুদ্ধের কি মহিয়সী শক্তি। 

ধর্ম্মশালায় যে কথোপকথন হইতেছিল ভগবান তাহা বুঝিতে পারিলেন এবং ভিক্ষুদিগকে দেখা দিবার অভিপ্রায়ে বুদ্ধশয্যা পরিত্যাগপূর্ব্বক বেশবিন্যাসে প্রবৃত্ত হইলেন। রক্তবর্ণ দোপাট্টার উপর বিদ্যুল্লতার ন্যায় কায়বন্ধ সংযোজিত হইল; সর্ব্বোপরি রক্তকম্বল-সদৃশ বুদ্ধোচিত মহাচীবর শোভা পাইতে লাগিল। যখন তিনি গন্ধকুটীর হইতে বাহির হইলেন, তখন তাঁহার অনন্ত বুদ্ধলীলা-শোভিত গতি দেখিয়া বোধ হইল যেন কোন কেশরী বা প্রমত্ত গজেন্দ্র চলিয়া যাইতেছে। তিনি সেই অলঙ্কৃত ধর্ম্মমণ্ডপে প্রভাময় বুদ্ধাসনে অধিরোহণ করিলেন; তাঁহার দেহনিঃসৃত ষড়বর্ণ রশ্মিজাল উদয়াচল-শিখরারূঢ় বালসূর্য্যের অণববক্ষঃপ্রতিফলিত অংশুমালার ন্যায় চতুর্দ্দিক উদ্ভাসিত করিল। সম্যকসম্বুদ্ধকে সমাগত দেখিয়া ভিক্ষুসঙ্ঘ তৎক্ষণাৎ তুষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করিলেন। শাস্তা সকরুণ দৃষ্টিতে সেই সভা অবলোকন করিয়া ভাবিলেন, এই পরিষৎ অতীব সুন্দর; কেহই অস্বাভাবিকভাবে হস্তপদ বিক্ষেপ করিতেছে না, হাঁচি, উৎকাসন পর্য্যন্ত শুনা যাইতেছে না। ইহারা বুদ্ধমাহাত্ম্যে এত শ্রদ্ধান্বিত এবং বুদ্ধতেজে এত অভিভূত যে আমি সমস্ত জীবন নিস্তব্ধ থাকিলেও, যতক্ষণ কথা না বলিব, ততক্ষণ অন্য কাহারও বাক্যস্ফূর্ত্তি হইবে না। অনন্তর তিনি সুমধুর ব্রহ্মভাষে ভিক্ষুদিগকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, ভিক্ষুগণ, তোমরা সভাস্থ হইয়া কি আলোচনা করিতেছিলে এবং আমাকে দেখিয়া কি বলিতে ক্ষান্ত হইলে?
তাঁহারা বলিলেনভগবন আমরা এখানে বসিয়া কোন অনাবশ্যক কথা বলি নাই; আমরা আপনারই গুণকীর্ত্তন করিতেছিলাম। মহাপন্থক তাঁহার কনিষ্ঠের প্রবৃত্তি বুঝিতে পারেন নাই; আপনার শক্তি অলৌকিক; আমরা এই সকল কথা বলিতেছিলাম। তাহা শুনিয়া শাস্তা বলিলেনভিক্ষুগণ, চুল্লপন্থক জন্মে আমার প্রভাবে পারত্রিক ঐশ্বর্য্যলাভ করিল, পূর্ব্ব এক জন্মেও সে আমারই প্রভাবে ঐহিক ঐশ্বর্য্য লাভ করিয়াছিল।

ভিক্ষুরা তখন ভগবানকে ইহার অর্থ ব্যাখ্যা করিতে অনুরোধ করিলেন; ভগবানও নিম্নলিখিত কথায় ভাবান্তর-প্রতিচ্ছন্ন সেই বৃত্তান্ত প্রকট করিয়া দিলেন :
পুরাকালে বারাণসী নগরে ব্রহ্মদত্ত নামে এক রাজা ছিলেন। তাঁহার সময় বোধিসত্ত্ব শ্রেষ্ঠীকুলে জন্ম গ্রহণ করেন এবং বয়ঃপ্রাপ্তির পর শ্রেষ্ঠীপদে নিযুক্ত চুল্লশ্রেষ্ঠী এই উপাধি প্রাপ্ত হন। তিনি পরম বিদ্বান বুদ্ধিমান ছিলেন এবং নিমিত্ত দেখিয়া শুভাশুভ গণনা করিতে পারিতেন। একদিন বোধিসত্ত্ব রাজদর্শনে যাইবার সময় পথে একটী মৃত মূষিক দেখিতে পাইলেন। তৎকালে আকাশে গ্রহ নক্ষত্র-গণের যেরূপ সংস্থান ছিল তাহা গণনা করিয়া তিনি বলিয়া উঠিলেন, ‘যদি কোন বুদ্ধিমান সদ্বংশজ ব্যক্তি এই মৃত ইদুরটা তুলিয়া লইয়া যায়, তাহা হইলে সে ব্যবসা করিয়া পরিবার পোষণে সমর্থ হইবে।
সময়ে এক ভদ্রবংশীয় অথচ নিঃস্ব যুবক সেই পথ দিয়া যাইতেছিল। সে বোধিসত্ত্বের কথা শুনিয়া ভাবিল, ইনি কখনও না জানিয়া শুনিয়া কোন কথা বলেন না। মরা ইদুরটা লইয়া গিয়া দেখি কপাল ফিরে কিনা। অনন্তর সে ইন্দুরটা তুলিয়া লইয়া গেল। নিকটে এক দোকানদার তাহার পোষা বিড়ালের জন্য খাবার খুঁজিতেছিল। সে যুবকের নিকট হইতে এক পয়সা দামে ইন্দুরটা কিনিল। যুবক তখন পয়সা দিয়া গুড় কিনিল এবং এক কলসী জল লইয়া, যে পথে মালাকারেরা বন হইতে পুষ্প চয়ন করিয়া ফিরে, সেইখানে গিয়া বসিল। অনন্তর মালাকারেরা যখন পুষ্প লইয়া ক্লান্তভাবে সেখানে উপস্থিত হইল, তখন যুবক তাহাদিগের প্রত্যেককে একটু একটু গুড় এক এক ওড়ং জল খাইতে দিল। মালাকারেরা তৃপ্ত হইয়া তাহাকে এক এক মুষ্টি ফুল দিয়া গেল। সে উহা বেচিয়া যে পয়সা পাইল তাহা দিয়া পর দিন বেশী গুড় কিনিল এবং ফুলের বাগানে গিয়া মালাকারদিগকে আবার খাওয়াইল। মালাকারেরা সে দিন তাহাকে যাহা হইতে অর্দ্ধ পরিমাণে ফুল তোলা হইয়াছে, এমন এক গুচ্ছ গাছ দিয়া গেল। এইরূপে ফুল ফুলগাছ বেচিয়া দুই চারি দিনের মধ্যে তাহার আট কাহণ পুঁজি হইল।
অনন্তর এক দিন খুব ঝড় বৃষ্টি হইল এবং রাজার বাগানে বিস্তর শুক্না কাঁচা ডালপালা ভাঙ্গিয়া পড়িল। মালী বেচারি কি উপায়ে এই আবর্জ্জনারাশি সরাইবে ইহা ভাবিতেছে, এমন সময় যুবক তাহার নিকট গিয়া বলিল, ‘যদি তুমি সমস্ত আমাকে বিনামূল্যে ছাড়িয়া দাও, তাহা হইলে এখনই আমি বাগান পরিষ্কার করিয়া দিতে পারি।মালী তৎক্ষণাৎ এই প্রস্তাবে সম্মত হইল। তখন যুবক, পাড়ার ছেলেরা যেখানে খেলা করিত সেইখানে গেল এবং ছেলেদিগকে একটু একটু গুড় খাইতে দিয়া বলিল,ভাই সকল, তোমরা আমার সঙ্গে আইস, রাজার বাগানটী পরিষ্কার করিতে হইবে।ছেলেরা গুড় পাইয়া বড় খুসি হইয়াছিল; তাহারা সন্তুষ্টচিত্তে ডালপালা সমস্ত তুলিয়া আনিয়া রাস্তার উপর গাদা করিয়া রাখিল।

সেদিন রাজার কুম্ভকারের কাঠের অনটন হইয়াছিল। সে হাঁড়ি কলসী পোড়াইবার জন্য কাঠ কিনিতে গিয়া ডালের গাদা দেখিতে পাইল এবং নগদ ষোল কাহণ কয়েকটী হাঁড়ি দিয়া সমস্ত কিনিয়া লইল।
সমস্ত খরচখরচা বাদে যুবকের হাতে এইরূপে চব্বিশ কাহণ মজুত হইল। সে তখন একটা নূতন ফিকির বাহির করিল। বারাণসীতে পাঁচ ঘেসেড়া ছিল। তাহারা প্রতিদিন মাঠে ঘাস আনিতে যাইত। যুবক নগরের বাহিরে এক স্থানে বড় বড় জালায় জল পূরিয়া রাখিল এবং উহা হইতে ঘেসেড়াদিগকে পিপাসার সময় জল দিতে লাগিল। ঘেসেড়ারা তৃপ্ত হইয়া বলিল, আপনি আমাদের এত উপকার করিতেছেন; বলুন, আমরা কোন প্রত্যুপকার করিতে পারি কি না। যুবক কহিল, তাহার জন্য এত ব্যস্ত কেন? যখন প্রয়োজন হইবে তোমাদিগকে জানাইব।

এই সময়ে যুবকের সহিত এক স্থলপথ-বণিক এক জলপথ-বণিকের বেশ বন্ধুত্ব জন্মিল। একদিন স্থলপথ-বণিক তাহাকে সংবাদ দিল, ভাই, কাল একজন অশ্ব-বিক্রেতা এই নগরে পাঁচ শত অশ্ব লইয়া আসিবে। এই কথা শুনিয়া যুবক ঘেসেড়াদিগকে বলিল, ‘ভাই সকল, তোমরা প্রত্যেকে কাল আমায় এক আটি করিয়া ঘাস দিবে এবং আমার ঘাস বেচা শেষ না হইলে তোমাদের ঘাস বেচিবে না। ঘেসেড়ারা যে আজ্ঞা বলিয়া তাহাই করিল। অশ্ববণিক আর কোথাও ঘাস না পাইয়া যুবকের নিকট হইতে হাজার কাহণ মূল্যে পাঁচশ আটি ঘাস কিনিয়া লইল।

ইহার কয়েক দিন পরে যুবক জলপথ-বণিকের নিকট জানিতে পারিল পট্টনে একখানি বড় জাহাজ মাল লইয়া আসিয়াছে। তখন সে আর একটা মতলব আঁটিল। সে কালবিলম্ব না করিয়া দিন ভাড়ায়[64] একখানি গাড়ী আনিল এবং উহাতে চড়িয়া মহাসমারোহে পট্টনে গিয়া উপস্থিত হইল। সেখানে সে জাহাজের সমস্ত মালের দর ঠিক করিয়া নিজের নামাঙ্কিত অঙ্গুরি দিয়া বায়না করিল; পরে তাঁবু খাটাইয়া তাহার মধ্যে অবস্থিতি করিতে লাগিল এবং অনুচরদিগকে বলিয়া দিল, কোন বণিক আমার সঙ্গে দেখা করিতে আসিলে তাহাকে যেন একে একে তিনজন আরদালি সঙ্গে দিয়া ভিতরে আনা হয়।
এদিকে পট্টনে বড় জাহাজ আসিয়াছে শুনিয়া বারাণসীর প্রায় একশত বণিক উহার মাল কিনিবার জন্য সেখানে গমন করিল; কিন্তু যখন শুনিল কোন মহাজন একাই সমস্ত মাল বায়না করিয়াছেন, তখন তাহারা অনুসন্ধান করিতে করিতে সেই যুবকের শিবিরে উপস্থিত হইল। সেখানে শিবিরের ঘটা এবং আরদালী, চোপদার প্রভৃতির ছড়াছড়ি দেখিয়া তাহারা মনে করিল এই যুবক নিশ্চিত অতুল ঐশ্বর্য্যের অধিকারী। তাহারা এক এক করিয়া যুবকের সহিত সাক্ষাৎ করিল এবং মালের এক এক অংশ পাইবার জন্য এক এক হাজার মুদ্রা লাভ দিতে অঙ্গীকার করিল। অনন্তর যুবকের নিজের যে অংশ রহিল, তাহারও কিনিবার জন্য তাহারা আর এক লক্ষ মুদ্রা লাভ দিল এইরূপে যুবক দুই লক্ষ মুদ্রা লাভ করিয়া বারাণসীতে ফিরিয়া গেল।

যুবক দেখিল বোধিসত্ত্বের পরামর্শ মত কাজ করাতেই তাহার অদৃষ্ট সুপ্রসন্ন হইয়াছে। অতএব কৃতজ্ঞতার নিদর্শনস্বরূপ সে একলক্ষ মুদ্রা লইয়া বোধিসত্ত্বকে উপহার দিতে গেল। বোধিসত্ত্ব জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি এত অর্থ কোথায় পাইলে?’ তখন যুবক, মরা ইন্দুর তুলিয়া লওয়া অবধি কিরূপে চারি মাসের মধ্যে সে বিপুল বিভবশালী হইয়াছে, সমস্ত বৃত্তান্ত খুলিয়া বলিল। তাহা শুনিয়া বোধিসত্ত্ব বিবেচনা করিলেনএই বুদ্ধিমান যুবক যাহাতে অন্য কাহারও হাতে গিয়া না পড়ে তাহা করিতে হইবে।অনন্তর তিনি তাহার সহিত নিজের প্রাপ্তবয়স্কা কন্যার বিবাহ দিলেন। বোধিসত্ত্বের অন্য কোন সন্তান ছিল না; কাজেই যুবক তাঁহার সমস্ত সম্পত্তির অধিকারী হইল এবং বোধিসত্ত্ব নিজকর্ম্মানুরূপ ফলভোগার্থ লোকান্তর গমন করিলে স্বয়ং বারাণসীর মহাশ্রেষ্ঠীপদ লাভ করিল।
কথাবসানে সম্যকসম্বুদ্ধ অভিসম্বুদ্ধভাব ধারণপূর্ব্বক এই গাথা পাঠ করিলেন :

লয়ে অল্প মূলধন প্রচুর ঐশ্বর্য্য লভে বুদ্ধিমান বিচক্ষণ জন;
লইয়া স্ফুলিঙ্গমাত্র, ফুৎকারে পোষণ করি, করে লোক মহাগ্নি সৃজন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

buttons=(Accept !) days=(20)

আমাদের ওয়েবসাইট আপনার অভিজ্ঞতা উন্নত করতে কুকিজ ব্যবহার করে। দয়া করে সম্মতি দিন। Learn More
Accept !