দেবদত্তের প্রব্রজ্যা (মিলিন্দপ্রশ্ন)

দেবদত্তের প্রব্রজ্যা

২৯। “ভন্তে! দেবদত্তকে কে প্রব্রজ্যা দিয়াছেন?”

“মহারাজ! (১) ভদ্দিয়, (২) অনুরুদ্ধ, (৩) আনন্দ, (৪) ভৃগু, (৫) কিম্বিল ও (৬) দেবদত্ত এই ছয় ক্ষত্রিয় কুমার এবং (৭) নাপিত উপালি শাক্যকুলের আনন্দ বর্ধন শাস্তা যখন বুদ্ধত্ব লাভ করেন তখন তাঁহারা ভগবানের অনুগামী হইয়া গৃহ ত্যাগ করেন। ভগবান তাঁহাদিগকে প্রব্রজিত করিয়াছেন।”

“ভন্তে! দেবদত্ত প্রব্রজিত হইয়া সংঘভেদ করিয়াছেন নহে কি?”

“হাঁ, মহারাজ! দেবদত্ত প্রব্রজিত হইয়া সংঘভেদ করিয়াছেন। গৃহী, ভিক্ষুণী, শিক্ষামনা, শ্রামণের অথবা শ্রামণেরী কখনও সংঘভেদ করিতে পারে না। একসঙ্গে বিনয় কর্মও প্রত্যয়-সংভোগ চলে এইরূপ প্রকৃত উপসম্পন্ন ভিক্ষু সমান-সীমায় বা বিনয় কর্মের নির্দিষ্ট স্থানে থাকিয়া সংঘভেদ করিতে পারে।”

“ভন্তে! যে সংঘভেদ করে সেই ব্যক্তির কি পরিণাম হইয়া থাকে?”

“মহারাজ! কল্পকাল (নরকে) অবস্থান করিতে হয়।”

“ভন্তে নাগসেন! আচ্ছা, বুদ্ধ পূর্বে জানিতেন কি দেবদত্ত প্রব্রজিত হইয়া সংঘভেদ করিবে এবং সংঘভেদ করিয়া কল্পকাল নরকে পক্ক হইতে থাকিবে?”

“হাঁ, মহারাজ! তথাগত জানিতেন দেবদত্ত প্রব্রজিত হইয়া সংঘভেদ করিবে এবং সংঘভেদ করিয়া কল্পকাল নরকে পক্ক হইতে থাকিবে।”

“ভন্তে! যদি বুদ্ধ জানিতেন দেবদত্ত প্রব্রজিত হইয়া সংঘভেদ করিবে এবং সংঘভেদ করিয়া কল্পকাল নরকে পক্ক হইতে থাকিবে, তবে বুদ্ধ মহাকারুনিক, অনুকম্পাকারী, পরম হিতৈষী, বিশ্বপ্রাণীর অহিত অপনোদন করিয়া হিত সাধন করেন, এই কথা মিথ্যা। পক্ষান্তরে যদি বুদ্ধ না জানিয়া দেবদত্তকে প্রব্রজ্যা দিয়া থাকেন তবে তিনি সর্বজ্ঞ নহেন। এই উভয়কোটিক প্রশ্ন আপনার নিকট স্থাপিত হইল। আপনি এই জটিল সমস্যার সমধান করুন। পরপ্রবাদ খ-ন করুন। ভবিষ্যৎ কালে আপনার ন্যায় বুদ্ধিমান ভিক্ষুরা দুর্লভ হইবেন। এ ক্ষেত্রে আপনার জ্ঞান বল প্রকাশ করুন।”

৩০। “মহারাজ! ভগবান মহাকারুনিক এবং সর্বজ্ঞ ছিলেন। ভগবান স্বীয় মহাকরুণা ও সর্বজ্ঞতা জ্ঞান দ্বারা দেবদত্তের গতি অবলোকন করিয়া দেখিলেন যে, দেবদত্ত অপায়গামী (নরকগামী) কর্ম সঞ্জয় করিয়া অনেক সহস্র কোটী কল্প পর্যন্ত নরক হইতে নরকান্তরে, অপায় হইতে অপায়ান্তরে গমন করিবে। ভগবান সর্বজ্ঞতা জ্ঞানে তাহা জানিতে পারিয়া (চিন্তা করিলেন)‘আমার শাসনে প্রব্রজিত হইলে তাহার অসীম কর্ম সসীম হইবে। পূর্বের সম্ভাব্য অসীম দুঃখ অপেক্ষা পরবর্তী দুঃখ সসীম হইবে। এই দৃঢ় পুরুষ প্রব্রজিত না হইলে বহু কল্প নরকে অবস্থান করিবে’Íসুতরাং তিনি করুনা বশতঃ দেবদত্তকে প্রব্রজিত করিয়াছেন।”

“ভন্তে নাগসেন! তাহা হইলে ভগবান বুদ্ধ পূর্বে আঘাত করিয়া পরে তৈল মালিশ করেন, প্রপাতে নিক্ষেপ করিয়া সাহায্যার্থ হাত বাড়াইয়া দেন, মারিয়া ফেলিয়া জীবন অন্বেষণ করেন, কেননা তিনি প্রথমে দুঃখ দিয়া পরে সুখের বিধান করেন।”

“মহারাজ! জীবগণের হিতের নিমিত্তই তথাগত উহাদিগকে আঘাত করিয়া থাকেন, নিক্ষেপ করেন এবং মারিয়া থাকেন। মহারাজ! যেমন মাতা-পিতা আঘাত করিয়া, নিক্ষেপ করিয়া পুত্র-কন্যার হিত সাধন করেন, সেইরূপ তথাগতও আঘাত করিয়া নিক্ষেপ করিয়া এবং মারিয়া জীবগণের হিতই সাধন করেন। যেই যেই উপায়ে প্রাণীদের গুণ বৃদ্ধি হয় সেই সেই উপায়ে তিনি সত্ত্বগণের হিত সাধন করেন। মহারাজ! যদি দেবদত্ত প্রব্রজিত না হইত তবে গৃহী অবস্থায় থাকিয়াও বহু নিরয়-সংপ্রবর্তক পাপ কর্ম করিয়া অনেক সহস্র কোটি কল্প পর্যন্ত নিরয় হইতে নিরয়ে অপায় হইতে অপায়ে গিয়া বহু দুঃখ ভোগ করিত।  ভগবান তাহা জানিয়া করুণাবশতঃ তাহাকে প্রব্রজিত করেন।‘আমার শাসনে (ধর্ম-বিনয় অনুসারে) প্রব্রজিত হইলে তাহার দুঃখ সসীম হইবে’ এই মনে করিয়া তিনি করুনায় বিগলিত হইয়া দেবদত্তের গুরু দুঃখকে লঘু করিয়াছেন। মহারাজ! যেমন, ধন, যশ, শ্রী এবং জ্ঞাতিবলে কোন বলবান পুরুষ স্বীয় প্রভাবে বিশ্বাস অর্জন করিয়া রাজা কর্তৃক গুরুতর দ- প্রাপ্ত জ্ঞাতি কিংবা মিত্রের কঠোর দুঃকে লঘু করেন, সেইরূপ ভগবান বহু সহস্র কোটি কল্প পর্যন্ত সম্ভাব্য দুঃখ ভোগী দেবদত্তকে প্রব্রজ্যা প্রদান করিয়া শীল, সমাধি, প্রজ্ঞা ও বিমুক্ত বল প্রভাবে তাহার গুরু দুঃখকে লঘু করিয়াছেন। মহারাজ! যেমন, কোন সুদক্ষ শল্যÍচিকিৎসক শক্তিবর্ধক ঔষধ প্রভাবে কঠিন রোগকে সহজ করে, সেইরূপ ভগবান বহুসহস্র কোটি কল্প ব্যাপী দুঃখ ভোগী দেবদত্তকে প্রব্রজিত করিয়া কারুণ্য বল সমৃদ্ধ ধর্মৌষধ প্রভাবে তাহার গুরুতর দুঃখকে লঘু করিয়াছেন। কেমন, মহারাজ যেই দেবদত্ত বহু দুঃখ ভোগের যোগ্য ছিল, তাহাকে অল্প ভোগের যোগ্য করিয়া ভগবান কি কিছু অপুণ্য অর্জন করিয়াছেন?”

“না, ভন্তে বিন্দুমাত্র অপুণ্যও অর্জন করেন নাই, এমন কি গোদোহন মাত্রও নহে অর্থাৎ গাভীর একটি বাঁট হইতে একবার দুধ টানিতে যত সময় লাগে তত পরিমানও নহে।”

“মহারাজ! এই কারণও যুক্তি হিসাবে স্বীকার করুন, যেই কারণে ভগবান দেবদত্তকে প্রব্রজ্যা দিয়াছেন।

মহারাজ! এ সম্বন্ধে অপর এক কারনও শ্রবণ করুন যেই কারণে ভগবান দেবদত্তকে প্রব্রজ্যা দিয়াছেন।

মহারাজ! যেমন পাপকারী চোরকে ধরিয়া আনিয়া জনগণ রাজাকে প্রদর্শন করে আর বলে‘দেব! এই ব্যক্তি পাপকারী চোর, আপনি ইহার যথেচ্ছা দণ্ড বিধান করুন।’ রাজা তাহাদিগকে বলেন‘ওহে! তাহা হইলে তোমরা নগরের বাহিরে মধ্যস্থানে নিয়া ইহার শিরশ্ছেদ কর।’‘হাঁ, দেব!’ বলিয়া লোকেরা রাজার আদেশ পাইয়া তাহাকে নগরের মধ্যস্থানে লইয়া গেল। সেই সময় রাজার নিকট হইতে বরপ্রাপ্ত, যশ, ধন ও ভোগ প্রাপ্ত, আস্থা ভাজন, বলবান এবং বিচার শক্তি সম্পন্ন কোন পুরুষ তাহাকে দেখিতে পায়। তিনি তাহার প্রতি করুণা করিয়া সেই ঘাতকগণকে এইরূপ বলেন,‘ওহে! অনর্থক ইহার শিরশ্ছেদ তোমাদের কি লাভ? বরং তোমরা ইহার হস্ত কিংবা পদ ছেদন করিয়া জীবন রক্ষা কর। ইহার জন্য আমি রাজার সকাশে প্রত্যুত্তর দিব।’ তাহারা সেই বলবানের আশ্বাস বাক্যে শরীর হস্ত কিংবা পদ ছেদন করিয়া জীবন রক্ষা করিল। মহারাজ! বলুন দেখি সেই পুরুষ এইরূপ করিয়া চোরের প্রতি কর্তব্য পরায়ন হইল কি?”

“ভন্তে! সেই পুরুষ চোরের জীবন দাতা, জীবন দান করিলে আর অকৃত কি রহিল?”

“হস্ত, পদ ছেদনের দরুন চোরের যে কষ্ট হইল তজ্জন্য তিনি কি কিছু পাপ অর্জন করিবেন?”

“ভন্তে! চোর নিজের কৃত কর্মের দরুন দুঃখ ভোগ করিতেছে। জীবন দাতা পুরুষ কিছু পাপ অর্জন করিবে না”

“মহারাজ! এইরূপে ভগবান কারুণ্যবশতঃ দেবদত্তকে প্রব্রজিত করিয়াছেন যে‘আমার ধর্ম-বিনয়ে প্রব্রজিত হইলে তাহার দুঃখ সসীম হইবে।” মহারাজ! ভগবান দেবদত্তের দুঃখ সসীম করিয়াছেন। মহারাজ! দেবদত্ত মরণ সময়ে এই বলিয়া আজীবনের জন্য শরণ গ্রহণ করেনঃ

‘আমি আমার এই প্রাণ ও অস্থিরাজি দ্বারা সেই বুদ্ধের শরণ লইতেছি, যিনি জগতে সর্বোত্তম পুরুষ, দেবাতিদেব, দম্য নরগণের মার্গ পরিচালক, সর্বদ্রষ্টা ও শতপুণ্যলক্ষণযুক্ত।’

“মহারাজ! এক কল্প ছয় অংশে বিভাগ করিয়া প্রথম অংশের শেষ সময়ে দেবদত্ত সংঘভেদ করিয়াছে। অবশিষ্ট পাঁচ অংশ কাল নরকে দুঃখ ভোগ করিবে এবং তথা হইতে মুক্ত হইয়া তিনি‘অস্থীশ্বর’ নামে প্রত্যেকবুদ্ধ হইবেন। মহারাজ! আপনি বলুন, ভগবান এইরূপ করিয়া দেবদত্তের উপকারী হইয়াছেন কি না?”

“ভন্তে! তথাগত দেবদত্তকে সর্বস্ব দিয়াছেন। কেননা, তিনি দেবদত্তকে প্রত্যেক বোধি লাভ করাইবেন। তাহার জন্য তথাগতের অকৃত কি ই বা আছে।”

“মহারাজ! দেবদত্ত সংঘভেদ করিয়া এখন নরকে দুঃখ ভোগ করিতেছেন, তজ্জন্য ভগবান কিছু অপুণ্যলাভ করিবেন কি?”

“না, ভন্তে! স্বীয় কর্ম-ফলেই ত দেবদত্ত কল্পকাল নরকে পক্ক হইতেছে। শাস্তা তাহার দুঃখ সসীম করিয়াছেন; সুতরাং তাঁহার কোন অপুণ্য হইবে না।”

“মহারাজ! এই কারণ আপনি সত্য হিসাবে স্বীকার করুন, কেন ভগবান দেবদত্তকে প্রব্রজিত করিয়াছেন।”

৩২। “মহারাজ! তৎপর আর এক কারন শ্রবণ করুন, কেন ভগবান দেবদত্তকে প্রব্রজ্যা দিয়াছেন। মহারাজ! কোন ব্যক্তি বাত, পিত্ত ও শ্লেষ্মার সন্নিপাত, ঋতুর পরিণাম, বিষম ব্যবহার, উপক্রমাদিতে আক্রান্ত হইয়া গলিত শবতুল্য দুর্গন্ধ-প্রবাহী, অব্যন্তরে যন্ত্রনা দায়ক, গর্তযুক্ত রক্তপূর্ণ পুঁষযুক্ত এক ব্রণ হইয়াছে। এক সুদক্ষ শল্য-চিকিৎসক উহার উপশমের উদ্দেশ্যে ব্রণ পাকাইবার নিমিত্ত প্রথমে ব্রণ মুখে কঠোর, তীক্ষ ক্ষার ও জ্জ্বালাকর ঔষধ দ্বারা প্রলেপ দেয়। যখন ইহা পাকিয়া নরম হয় তখন অস্ত্রোপাচার করিয়া ঔষধ যুক্ত শলাকাদ্বারা জ্জ্বালাইয়া দেয়। দগ্ধ হইলে ক্ষার লবণ নিক্ষেপ করে এবং ব্রণের মাংসবৃদ্ধি ও রোগীর আরোগ্য লাভের জন্য ঔষধের প্রলেপ দেয়। মহারাজ! বলুন দেখি, সেই শল্য-চিকিৎসক কি রোগীর প্রতি অহিত চিত্ত হইয়া ঔষধের প্রলেপ দেয়, অস্ত্রোপচার করে, শলাকাদ্বারা জ্বালায়, ক্ষারলবণ প্রক্ষেপ করে?”

“না, ভন্তে! চিকিৎসক হিত চিত্ত হইয়া রোগীর মঙ্গল ইচ্ছায় এই সকল প্রক্রিয়া করিয়া থাকে।”

“এই ভাবে চিকিৎসা প্রক্রিয়া করার ফলে রোগীর যে দুঃখ বেদনা হয় তাহার দরুন শল্য-চিকিৎসক কিছু অপুণ্য অর্জন করে কি?”

“ভন্তে! চিকিৎসক হিতচিত্ত হইয়া আরোগ্যর ইচ্ছায় এই সকল প্রক্রিয়া করিয়াছে, তাহার জন্য কি অপুণ্য হইবে? বরং সে অগ্রপুণ্যের অধিকারী হইবে।”

“মহরাজ! এইরূপেই ভগবান দয়ার্দ্র চিত্ত হইয়া দুঃখ হইতে মুক্তির নিমিত্ত দেবদত্তকে প্রব্রজিত করিয়াছেন।”

৩৩। “মহারাজ! তৎপর অপর এক কারণ শ্রবণ করুন, যে কারণে ভগবান দেবদত্তকে প্রব্রজ্যা দান করিয়াছেন।”

“মহারাজ! কোন লোক একটি কন্টকবিদ্ধ হইল। তাহার কোন শুভানুধ্যায়ী হিতচিত্ত ব্যক্তি তিক্ষ কাঁটা কিংবা শস্ত্রমূখী কন্টকের চতুর্দিকে ছেদন পূর্বক রক্তপাত করিয়া সেই কন্টক বাহির করিল। মহারাজ! সেই ব্যক্তি অহিতৈষী হইয়া সেই কন্টক বাহির করিল কি?”

“না, ভন্তে! হিতকামী ও স্বস্তিকামী হইয়া সেই ব্যক্তি কন্টক বাহির করিয়াছে। যদি ভন্তে সে কন্টক উদ্ধার না করিত তবে তাহার মৃত্যু কিংবা মৃত্যুর সমান দুঃখ হইত।”

“মহারাজ! এইরূপই, ভগবান করুণা প্রণোদিত হইয়া দেবদত্তকে দুঃখ লাঘবের জন্য প্রব্রজিত করেন। যদি ভগবান তাহাকে প্রব্রজ্যা না দিতেন তবে সহস্র কোটি কল্পাবধি দেবদত্ত জন্ম পরম্পরায় নিরয়ে পরিপক্ক হইত।”

“হাঁ, ভন্তে! তথাগত পাপের অনুকুল স্রোতে ভাসমান দেবদত্তকে প্রতিস্রোতে আনিয়াছেন, বিপথগামী দেবদত্তকে সুপথ প্রদর্শন করিয়াছেন, প্রপাতে পতিত দেবদত্তকে উদ্ধার করিয়াছেন ও বিষমস্থানগামী দেবদত্তকে সমস্থানে আনয়ন করিয়াছেন।”

“ভন্তে! আপনার ন্যায় বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান ব্যক্তি ব্যতীত এই সকল হেতু, এই সকল কারণ অন্যের দ্বারা প্রদর্শন করা সম্ভব হইত না।”



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

buttons=(Accept !) days=(20)

আমাদের ওয়েবসাইট আপনার অভিজ্ঞতা উন্নত করতে কুকিজ ব্যবহার করে। দয়া করে সম্মতি দিন। Learn More
Accept !