চীন রাজার সত্যবল
“মহারাজ! চীনদেশে এক রাজা ছিলেন। তিনি ক্রীড়ার মানসে প্রতি চার মাসে এক এক বারসত্যক্রিয়া করিয়া রথ সহ মহাসমুদ্রে এক যোজন পর্যন্ত প্রবেশ করিতেন। সেই সময় তাঁহাররথের অগ্রভাগের সম্মুখ হইতে জল রাশি সরিয়া যাইত। যখন তিনি রথসহ ফিরিয়া আসিতেন তখন জলরাশিপুনরায় স্বস্থানে ফিরিয়া আসিত। মহারাজ! দেবমানবের সম্মিলিত স্বাভাবিক দেহবলের দ্বারাসমুদ্রের জলরাশিকে অপসারিত করা সম্ভব কি?”
“ভন্তে! অতি সমান্য পুষ্করিণীর জলও দেব-মানবের স্বাভাবিক বলে অপসারিত করা সম্ভব
নহে। মহাসমুদ্র জলের কোথায় বা কি?” “মহারাজ! এই কারণেও সত্যবল জানা উচিত যে জগতে এমন
কোন কিছু নাই যাহা সত্যবলে পাওয়া যায় না।”
বিন্দুমতীর সত্যবল
৪৫। “মহারাজ! একদিন পাটলিপুত্র (=পাটনা)-নগরে ধর্মরাজ অশোক নগর ও জনপদবাসীগণ,
অমাত্য, সৈন্যবল ও মহামন্ত্রীতে পরিবৃত হইয়া গঙ্গানদী দর্শনে গিয়াছিলেন। সেই সময় গঙ্গানদী
নব জল ধারায় কানায় কানায় পরিপূর্ণ হইয়াছিল। সেই পঞ্চশত যোজন দীর্ঘ ও এক যোজন বিস্তৃত
ভরানদী দেখিয়া ধর্মরাজ অশোক অমাত্যদিগকে কহিলেন,‘ওহে! এই মহাগঙ্গার স্রোতকে উর্দ্ধদিকে
প্রবাহিত করিতে সমর্থ এমন কেহ আছে কি?’
অমাত্যগণ বলিলেন,‘দেব! ইহা কেইবা করিতে পারিবে?”
সেই সময় বিন্দুমতী নামে এক গণিকাও সেই গঙ্গাতীরে উপস্থিত ছিল। সেই রাজার জিজ্ঞাসা
শুনিয়া মনে মনে বলিলÍ‘আমি এই পাটলিপুত্র নগরে রূপাজীবা গণিকা, আমার বৃত্তি অতি নিকৃষ্ট
শ্রেণীর। তথাপি রাজা আমার সত্যক্রিয়া দর্শন করুন।’ তখন নিজের সত্য ক্রিয়া করিল। তাহার
সত্যক্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মহাগঙ্গা কলকল ধ্বনিতে উর্ধ্বদিকে প্রবাহিত হইতে লাগিল। মহাজনসংঘ
তাহা দেখিতে পাইল। তখন রাজা গঙ্গার আবর্ত ও উর্মি-বেগ-সঞ্জাত কলকল শব্দ শুনিয়া বিষ্মিত
ও আশ্চর্যান্বিত হইলেন এবং ভাবাবেগে অমাত্যগণকে কহিলেন,‘ওহে! কেন এই মহাগঙ্গা উর্ধ্বস্রোতে
বহিতেছে?’‘মহারাজ! আপনার প্রশ্ন শুনিয়া বিন্দুমতী গণিকা সত্যক্রিয়া করিয়াছে, তাহার
ইচ্ছা শক্তি প্রভাবে নদী উপর দিকে বহিতেছে।’
তখন রাজা অতি বিষ্মিত হৃদয়ে অবিলম্বে স্বয়ং গণিকার নিকট গিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন,‘ওরে!
(জে!) সত্যই কি তোমার সত্য প্রভাবে এই গঙ্গা উপরদিকে প্রবাহিত হইতেছে?’
‘হাঁ, মহারাজ!’
রাজা কহিলেন,‘ইহাতে তোমার কি সত্যবল আছে? পাগল ব্যতীত অন্য কে তোমার বাক্য বিশ্বাস
করে? কোন বলে তুমি গঙ্গাকে উপরদিকে প্রবাহিত করিলে?”
সে বলিলÍ‘মহারাজ! স্বীয় সত্যবলে আমি মহাগঙ্গাকে উর্ধ্বস্রোতে প্রবাহিত করাইয়াছি।’
রাজা বলিয়া উঠিলেন,‘অরে! তোমার ন্যায় চোরণী, ধুর্তা, অসতি, কুলটা, পাপাশয়া,
ভ্রষ্টচরিত্রা লজ্জাহীনা এবং অজ্ঞজন প্রলুব্ধকারিণী নারীর আবার সত্য বল কি?’
‘মহারাজ! আপনি সম্পূর্ণ ঠিকই বলিয়াছেন। আমি তাদৃশী নারী। তথাপি আমার সত্য এত
প্রভাবযুক্ত যে তৎদ্বারা আমি দেব-মানব এই পৃথিবীকে উল্টাইয়া দিতে পারি।’
রাজা কহিলেন,‘সেই সত্যক্রিয়া কি, বেশ, আমাকে শোনাও দেখি?’
‘মহারাজ! ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ, বৈশ্য, শূদ্র কিংবা অপর যে কোন জাতির হউক না কেন,
যিনি আমাকে ধন দেন তাঁহাদের সকলকে সমান ভাবে পরিচর্যা করি। আমার কাছে ক্ষত্রিয় উচ্চ
বলিয়া বিশেষ সম্মান নাই; শূদ্র নীচ বলিয়া অবমাননা নাই। আমি অনুরাগ ও বিরাগ পরিহার করিয়া
যিনি আমার প্রাপ্য দেন তাঁহারই তৃপ্তি সাধনে তৎপর হই। মহারাজ! ইহাই আমার সত্যবল যাহার
প্রভাবে এই মহাঙ্গাকে উপরদিকে প্রবাহিত করিলাম।’
[এই কাহিনী বলিয়া আয়ুষ্মান নাগসেন কহিলেন]
৪৬। মহারাজ! জগতে এমন কোন কাজ নাই যাহা সত্যের উপর দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি করিতে
পারেন না। মহারাজ! শিবিরাজা যাচককে নিজের চক্ষুযুগল দান করিয়াছেন, এবং তাঁহার সত্যবলে
পুনরায় দিব্য চক্ষু লাভ হইয়াছিল; উহা কেবল তাঁহা সত্যক্রিয়ার প্রভাবেই সম্ভব হইয়াছে।
মহারাজ! যাহা সূত্রে বলা হইয়াছেÍ‘মাংস চক্ষু নষ্ট হইলে হেতু ও কারণ ব্যতিরেকে
দিব্যচক্ষু উৎপন্ন হয় না’ তাহা ভাবনাময় চক্ষু সম্বন্ধে বলা হইয়াছে। মহারাজ! তাহা এইরূপই
ধারণ করুণ।”
“সাধু, ভন্তে! নাগসেন! আপনি প্রশ্ন সুন্দররূপে বিবৃত করিয়াছেন। নিগ্রহস্থান
নির্দেশ করিয়াছেন, বিপক্ষের মতবাদ মর্দিত করিয়াছেন। আপনি যে ভাবে ব্যক্ত করিলেন, আমি
সে ভাবে ধারণ করিতেছি।”
আমাদের কমেন্ট করার জন্য ধন্যবাদ। আমরা আপনার কমেন্ট পড়া মাত্র প্রতিক্রিয়া জানাতে চেষ্টা করবো।