বৌদ্ধ অনাত্মবাদ

 

Buddha Auntthabad

ড. শশীভূষণ দাশগুপ্ত রচিত: বৌদ্ধধর্ম ও চর্যাগীতি থেকে সংকলিত

হিন্দুধর্ম এবং দর্শনের চিন্তাধারার সহিত সুপরিচিত মনের পক্ষে বৌদ্ধধর্ম এবং দর্শনের ভিতরকার যে সব চিন্তা খুব সহজগ্রাহ্য নয়, তাহাদের ভিতরে প্রধান হইল বৌদ্ধ অনাত্মবাদ। আত্মবাদ ভারতীয় হিন্দুমনের একটি দৃঢ়মূল সংস্কার; সেখানে নাড়া পড়িলে আমাদের মনের ভিত্তিতেই যেন একটা নাড়া বোধ করি, এবং তাহারই পর্যবসান একটি অস্বস্তিকর মানসিক দ্বন্দ্বে।

বৌদ্ধ অনাত্মবাদ কি জিনিস তাহা ভাল করিয়া বুঝিতে হইলে হিন্দু আত্মবাদ কি জিনিস তাহা ভাল করিয়া বিশ্লেষণ করিয়া বুঝিয়া লইতে হয়। আমরা আমাদের বর্তমান আলোচনায় এই হিন্দু আত্মবাদ এবং বৌদ্ধ অনাত্মবাদের বিশ্লেষণে দার্শনিক সূক্ষ্ম তর্ক যথাসম্ভব বাদ দিয়া আমাদের সাধারণ জ্ঞানবুদ্ধির উপরেই বিশেষভাবে নির্ভর করিতে চেষ্টা করিব।

হিন্দুধর্মের আত্মবাদের ভিতরে আমরা আত্মার দুইটি রূপ দেখিতে পাইতেছি; আত্মা যেখান এক, সর্বব্যাপী, অভিন্ন এবং সর্বপ্রকার উপাধি-বিনিমুক্ত সেখানে আমরা তাহাকে গ্রহণ করি পরমাত্মা বলিয়া, আর প্রত্যেক জীবের ভিতরে তাহার পৃথক পৃথক গুণকর্মাদি দ্বারা উপাধিগ্রস্ত বা সীমাবদ্ধ যে আত্মা তাহাই জীবাত্মা।

আমাদের মনের মধ্যে যে জীবাত্মার ধারণাটি রহিয়াছে তাহাকে আমরা বিশ্লেষণ করিলে আবার দুইটি জিনিস দেখিতে পাই, একটি হইল আত্মা, অপরটি হইল জীব, যদিও আমাদের মনের মধ্যেই এই দুইটি অবিচ্ছিন্নভাবে মিলিয়া থাকে।

জীবকে আমরা আমাদের সাধারণ বুদ্ধিতে বলিতে পারি আমাদের ব্যক্তিসত্তা; এই ব্যক্তিসত্তার আমরা স্বভাবইতঃই একটি শ্বাশ্বত অধিষ্ঠান বা আশ্রয় খুঁজি সেই শাশ্বত অধিষ্ঠান বা আশ্রয়ই হইল আত্মা।

আমাদের ভিতরে যে একটি ব্যক্তিসত্তার বোধ দেখিতে পাই তাহা আমাদের ভিতরে কি করিয়া গড়িয়া ওঠে? সর্বপ্রকার ধর্মসংস্কার বাদ দিয়া যদি বিশুদ্ধ মনোবিজ্ঞানের দিক হইতে জিনিসটি বিচার করি তবে দেখিতে পাই, আমাদের সর্ববিধ কর্ম প্রচেষ্টার ভিতর দিয়া আমাদের একটি চেতনার ধারা গড়িয়া উঠিতেছে এবং এই চেতনার ধারা আমাদের কর্মপ্রবাহের সঙ্গে সঙ্গে একটি নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহত্বও লাভ করিতেছে।

আমাদের চৈতন্যের ভিতরে এই অবিচ্ছিন্ন প্রবাহত্ব দান করিতেছে যে শক্তিটি তাহাকে আমরা সাধারণ নাম দিতে পারি স্মৃতি। এই স্মৃতিশক্তি একটি অপূর্ব রহস্যময়ী শক্তি আমাদের স্পষ্ট চেতনলোকের ভিতরে আমরা যেমন তাহার দেখা পাই আমাদের অবচেতন, অচেতন লোকের ভিতরেও ইহার গভীরতর কাজ চলিতেছে। আসলে এই স্মৃতিশক্তি হইল একটি ধারক শক্তি যাহা আমাদের চেতনার কোনও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকেই একেবারে হারাইয়া যাইতে দেয় না, তাহাদিগকে বিধৃত করিয়া পরস্পর পরস্পরের সহিত যুক্ত করিয়া দেয়।

এই যোগের ফলেই আমাদের চেতনার সকল মুহূর্তের সকলটি অংশ একত্রিত হইয়া একটি অখণ্ড প্রবাহের সৃষ্টি করে। আবার আরও লক্ষ্য করিলে দেখিতে পাইব, আমাদের চেতন-প্রবাহের মধ্যে শুধু যে একটা অনবচ্ছিন্নতার বা অখণ্ডতাই (continuity) রহিয়াছে তাহা নহে, তাহার সঙ্গে আবার আছে একটি ঐক্যের প্রত্যয় (sense of identity) অর্থাৎ যে আমি একদিন ক্ষুদ্র শিশুরূপে উত্তানশয়ান হইয়া হাতপা ছুঁড়িয়া খেলা করিয়াছি, সেই আমিই যৌবনে সকল রঙিন স্বপ্নের পিছনে ছুটিয়াছি, আমার প্রৌঢ়বয়সে কর্ম চিন্তার প্রৌঢ়ত্ব লাভ করিয়াছি। স্মৃতিশক্তিরূপে আমাদের ভিতরে যে ধারকশক্তিটি রহিয়াছে সে আমার শৈশব, কৈশোর, যৌবনের সকল যুগের সকল প্রকার চেতনার ভিতরে একটা ঐক্যদান করিয়াছেসেই ঐক্যের বোধ আমার বহান স্পষ্ট চেতনলোকের মধ্যে হয়ত অল্প আমার অবচেতন এবং অচেতনের ভিতরেই অধিক।

চেতনার এই অনবচ্ছিন্নতা বোধের সহিত আমাদের যুক্ত হইয়া থাকে আর একটি বোধতাহা হইল এই, আমরা বুঝিতে পারি যে আমার শৈশব, কৈশোর, যৌবন, প্রৌঢ়ত্বের ভিতর দিয়া অবিচ্ছিন্নরূপে প্রবাহিত হইয়া আসিয়াছে যে চেতন- প্রবাহ তাহার ভিতরে কোথাও কোনও অংশের সহিত অপর কোন অংশের কোনও মৌলিক পার্থক্য নাইমূলতঃ সে একই।

এই একত্বের বোধ আসিবার সঙ্গে সঙ্গেই একের আশ্রয় বা অধিষ্ঠানরূপে দেখা দেয় একটি ব্যক্তিত্ব- বোধ। অর্থাৎ আমরা মনে করি, একটি বিশেষ জীবন- প্রবাহের ভিতর দিয়া একটি বিশেষ সত্তাই নিজেকে বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন স্তরের ভিতর দিয়া নানাভাবে ব্যক্ত করিতেছে।

সমগ্র জীবন প্রবাহের ভিতর দিয়া 'ব্যক্তি' বা প্রকাশ লাভ করিতেছে যে সত্তা তাহাই হইল আমার ব্যক্তি- সত্তা। এই ব্যক্তি-সত্তাই হইল জীব।

এখন প্রশ্ন হয় এই যে, একটি বিশেষ জীবনের মধ্যে যে একটি বিশেষ ব্যক্তি পুরুষের সাক্ষাৎ লাভ করিলাম তাহা কি কালের স্রোতের মধ্যে একটি ভাসমান সত্তা মাত্র। এক জীবনের শেষ হইয়া যাইবার সঙ্গে সঙ্গেই কি তাহা শেষ হইয়া যায়, না বহুজীবনের ভিতর দিয়া সেই একই সত্তা অবিচ্ছিন্ন প্রকাশ লাভ করে? এইখানেই জাগে আমাদের ভিতরে একটি 'শাশ্বত'- বোধএই জীবসত্তা একান্তভাবেই কালস্রোতে একটি ভাসমান সত্তামাত্র নহে ইহার একটি শাশ্বত রূপ আছে ইহাই হইল আত্মা।

এই সকল আত্মার পিছনে রহিয়াছেন আবার এক অখণ্ড আত্মাতিনিই পরমাত্মা।

হিন্দুদের ভিতরে কেহ কেহ বলিবেন যে, এই আত্মা সর্বদাই এক এবং অখণ্ডজীব রূপে তাহা কখনই খণ্ডিত হয় না, জীবত্ব একটি গুণকর্মগত উপাধিমাত্রউহা আমাদের দৃষ্টিকেই খণ্ডিত করিয়া এককেই বহুভাবে প্রতিভাত করে। অপরে বলিবেন, সেই এক পরমাত্মাই আত্মশক্তিবলে নিজেকে খণ্ডিত বা অংশরূপে পরিণত করেন মূলে এক থাকিলেও পরিণতিতে ভেদ দেখা দেয়। আমরা উপরে হিন্দু আত্মবাদের যে সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ করিলাম তাহার ভিতরে লক্ষ্য করিলেই দেখিতে পাইব, মূলে রহিয়াছে জীবন প্রবাহ সম্বন্ধে একটি অবিচ্ছিন্নতা- বোধ এবং তাহার সহিত যুক্ত একটি একত্ববোধ (sense of continuity and identity)

বৌদ্ধ দার্শনিক তাঁহাদের অনাত্মবাদ স্থাপন করিতে গিয়া এই প্রচলিত অবিচ্ছিন্নতা এবং একত্বের সংস্কার এবং তজ্জনিত বিশ্বাসের উপরেই আঘাত করিয়াছেন। এই অবিচ্ছিন্নতা- বোধ এবং একত্ব- বোধ উভয়ই ভ্রান্তিজনিত। জীবনের কর্ম- প্রবাহই বলি বা চেতন- প্রবাহই বলিকোথাও অবিচ্ছিন্নতা নাইআছে পরস্পর পৃথক্ পৃথক্ অস্তিত্ব সমূহের সন্তুতিঅথবা দ্রুত সংঘটনের ধারা।

ক্ষুদ্র একটি বটের বীজ হইতে সহস্র কাণ্ড, শিকড়, শাখা, পল্লব বিস্তারিত যে বিরাট বটবৃক্ষের বিকাশ ইহার ভিতরে কোনও অখণ্ডতা নাই। প্রত্যেকটি ক্ষণের দ্বারা তাহার অস্তিত্ব পৃথক্-কৃত; প্রতিক্ষণের মধ্যে পৃথক-কৃত অস্তিত্ব সমূহের একটি সন্ততি (series) হইল এই বিরাট বটবৃক্ষটি; কিন্তু ক্ষণের অতিদ্রুত পরম্পরার সঙ্গে সঙ্গেই চলিয়াছে তাহার অস্তিত্বের পরম্পরা; পরম্পরার এই অতিদ্রুততার জন্য প্রতিক্ষণের অস্তিত্বের মধ্যে যে পার্থক্য রহিয়াছে আমাদের ইন্দ্ৰয়ানুভূতি তাহাকে গ্রহণ করিতে পারে না, ইহারই ফলে আমরা সমস্ত জিনিসটিকেই একটি অবিচ্ছিন্ন প্রবাহ মনে করিয়া তাহার অস্তিত্বের প্রথমক্ষণ হইতে শেষক্ষণ পর্যন্ত একটি একত্বের আরোপ করিয়া থাকি।

এই বৃক্ষ- জীবনের সম্বন্ধে যাহা সত্য আমাদের মানবজীবনের সম্বন্ধেও তাহাই সত্য। একদিনের শিশু এবং আশী বৎসরের বৃদ্ধটির জীবন জুড়িয়া যে অস্তিত্ব প্রবাহ দেখিতে পাই তাহার ভিতরে কোথাও অবিচ্ছিন্নতা এবং আসল একত্ব নাই; প্রতিক্ষণেই তাহার অস্তিত্ব নব হইতে নবতর রূপ গ্রহণ করিতেছে; সুতরাং প্রতিক্ষণেই তাহার অস্তিত্ব তাহার পূর্বক্ষণের এবং পরক্ষণের অস্তিত্ব হইতে পৃথক্। একটি দ্রুত সন্নিহিতির সন্ততি তাহার সকল অস্তিত্ব- প্রবাহ এবং চেতন- প্রবাহের (বৌদ্ধরা ইহাকে বলিয়াছেন বিজ্ঞান-প্রবাহ) ভিতরে একটা কল্পিত অনবচ্ছিন্নতা এবং একত্ব দান করিয়াছে, তাহাকে অবলম্বন করিয়াই প্রতিভাত হয় তাহার ব্যক্তি-সত্তা বা আত্মাবৌদ্ধরা যাহার নাম দিয়াছেন পুগল।

এই যে মানবজীবনের ঐক্যহীন সন্ততি ইহাকে বৌদ্ধ দার্শনিকগণ নানা দৃষ্টান্তের সাহায্যে বুঝাইবার চেষ্টা করিয়াছেন। অনেক সময় তাঁহারা গঙ্গা- প্রবাহের উদাহরণ দিয়াছেন। হিমালয়ের কোন দুর্গম কন্দর হইতে এই প্রবাহের প্রথম যাত্রাকত যুগ যুগ ধরিয়া কত পার্বত্যভূমি, বনাঞ্চল, নগর- পল্লীর ভিতর দিয়া কত বিচিত্র প্রবাহে সে চলিয়া আসিয়াছে আমরা তাহার সমগ্র প্রবাহকে জুড়িয়া একটি একক এবং অখণ্ড অস্তিত্ব কল্পনা করিয়া লইয়াছি।

আসলে তাহার কোনও দিন কোথাও কোনও এক এবং অখণ্ড অস্তিত্ব ছিল না। তাহার যে স্রোত তাহা পরস্পর সন্নিহিত অসংখ্য অস্তিত্বস্রোত মাত্র। সেই অসংখ্য অস্তিত্বের প্রবাহ লইয়া সে যেমন এক বলিয়া প্রতিভাত হয়, মানুষের জীবন প্রবাহের ভিতর দিয়াও মানুষ তেমন করিয়াই এক বলিয়া প্রতিভাত হয়। আবার আমরা দেখিতে পাই, সন্ধ্যাবেলায় আমরা একটি প্রদীপ জ্বালিয়া দিলাম; তাহার জ্বলন-ক্রিয়া প্রতি মুহূর্তেই পৃথক; তথাপি প্রদীপটি সারারাত্র ধরিয়া যখন জ্বলিতে থাকে তখন আমরা বলি, সন্ধ্যার প্রদীপটিই প্রথম প্রহরের প্রদীপপ্রথম প্রহরের প্রদীপই নিশীথের প্রদীপ, নিশীথের প্রদীপই আবার শেষ রাত্রির প্রদীপ। আসলে যাহা হইল জ্বলন- প্রবাহমাত্র তাহাকেই আমরা প্রদীপের একত্ব বলিয়া ভুল করিতেছি।

দৃষ্টান্তটি আর একটু অন্য রকম করিয়া বলিলে এক্ষেত্রে আমাদের ভুলটা আরও অধিক স্পষ্টরূপে চোখে পড়িবে। ধরা যাক্, আমরা একটি দীপ হইতে অপর আর একটি দীপ জ্বালাইয়াছি, অপরটি হইতে আবার পৃথক আর একটি দীপ জ্বালাইয়াছিএইরূপে অসংখ্য দীপ জ্বালাইয়া তাহাদিগকে পরস্পর অতি সন্নিকটে ক্রমান্বয়ে একটি সরলরেখায় স্থাপিত করিয়া একটু দূর হইতে যদি তাহাদের প্রথমটি হইতে শেষটির প্রতি দৃষ্টিপাত করি তাহা হইলে আমরা দেখিতে পাইব বহুদূর বিস্তৃত একটি প্রদীপের রেখা; আসলে সেখানে সেই প্রদীপ- ধারার ভিতরে নিরবচ্ছিন্নত্বও আমাদের দেখার ভুল, একত্বও আমাদের দেখার এবং বিচারের ভুল। কিন্তু তাহা হইলে বৌদ্ধধর্মেব্যক্তি-সত্তাবাআমিবলিয়া কি কোনও কিছুকেই স্বীকার করা হয় না?

হয় বৈ কি, পুগলই হইল এই 'আমি' কিন্তু এই পুগলের বাআমি কোনও আসল সত্তা নাই, পঞ্চস্কন্ধকে অবলম্বন করিয়া তাহার একটি ব্যবহারিক সত্তা মাত্র প্রতীত হয়। আসলে এই 'আমি' বা ব্যক্তিসত্তার পিছনের কোনও আত্মা নাই, এই 'আমি' আসলে 'নাম- রূপ' ছাড়া আর কিছুই নহে। নাম-রূপ হইল জড় বা চেতন স্কন্ধসমূহের সমবায়ে প্রতিভাত লোকব্যবহারের উপযোগী একটা তৎকালিক সত্তা- প্রতীতি মাত্র।

রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার বিজ্ঞান এই পঞ্চস্কন্ধের সমবায়ে গঠিত আমাদের ব্যক্তিসত্তা; এখানে গঠিত শব্দের অর্থ এই নয় যে, এই পঞ্চস্কন্ধ একত্রিত হইয়া আমাদের 'ব্যক্তি' নামক একটি স্বতন্ত্র- সত্তাকে উৎপন্ন করে; গঠিত শব্দের অর্থ হইল, এই পঞ্চস্কন্ধ একত্রিত হইলে তাহা হইতে ব্যবহারিক বা সাংস্কৃতিক ভাবে আর একটি ব্যক্তিসত্তা বা পুগলের প্রতীতি মাত্র হয়। এই তত্ত্বটি প্রসিদ্ধমিলিন্দপঞহোগ্রন্থের একটি চমৎকার আখ্যানের ভিতর দিয়া প্রকাশ করা হইয়াছে।

সেখানে দেখিতে পাই, রাজা মিলিন্দ শ্রদ্ধেয় ভিক্ষু নাগসেনকে জিজ্ঞাসা করিতেছেন, 'হে শ্রদ্ধেয় ভিক্ষু, আপনার নাম কি?' নাগসেন বলিলেন, 'আমার নাম নাগসেন।' কথাটি বলার সঙ্গে সঙ্গেই নাগসেনের খেয়াল হইল, রাজা 'আমার নাম নাগসেন' শুনিয়া হয়ত মনে করিতে পারেন যে, তাহা হইলে আমাদের এই পঞ্চস্কন্ধাত্মক অবয়বের মধ্যেআমিবলিয়া একটি সত্যকারের কোনও সত্তা রহিয়াছে এবং 'নাগসেন' নামটি দ্বারা সেই সত্তাটিকেই লক্ষ্য করা হইতেছে; এই মনে করিয়া ভিক্ষু নাগসেন বলিলেন, ‘মহারাজ, এই নাগসেন একটি নাম মাত্র বা লোকের ব্যবহারিক সুবিধার জন্য গৃহীত একটি সংজ্ঞা মাত্র, এই নাগসেন নামের দ্বারা কোনও ব্যক্তিকে বা অবয়বের অন্তর্নিহিত কোনও অবয়বীকে বুঝাইতেছে না।' কিন্তু নাগসেনের এই জবাবে রাজা মিলিন্দ অধিকতর ধাঁধার ভিতরে পড়িয়া গেলেন। যদি দেহের মধ্যে কোনও দেহী কেহ না থাকে তবে যাহা কিছু সব উপভোগ করে কে? যতসব শাস্ত্রবিহিত ভাবনা- অভ্যাসতাহাই বা কে করে? সাধনার জন্য আমরা যে মার্গ অবলম্বন করি সেই মার্গফলই বা প্রত্যক্ষ করে কে? জীবনের সকল কর্মের পিছনে যদি একজন কর্তা না থাকে তবে কুশল-অকুশল কর্মই বা কে করেতাহার ফলই বা কে ভোগ করে? আর কর্তা বা ভোক্তা যদি নাই থাকে তবে কর্মের কুশলত্ব অকুশলত্বই বা স্থির হইবে কি করিয়া?—কারণ কর্তার উপরে কর্মফলের অনুকূল বা প্রতিকূল প্রতিক্রিয়া দ্বারাই আমরা কর্মের কুশলত্ব বা অকুশলত্ব নির্ধারণ করি। আর যদি ব্যক্তিসত্তা বলিয়া কোনও জিনিসই না থাকে তবে আচার্যই বা কে, উপাধ্যায়ই বা কে, উপসম্পদাও বা কাহার হয়? সুতরাং রাজা মিলিন্দ বলিলেন— 'হে ভিক্ষু, আপনি আমার সংশয়াচ্ছয় চিত্তকে আরও সংশয়াচ্ছন্ন করিয়া আপনার বক্তব্যকে আরও রহস্যাবৃত করিয়া কথা বলিবেন না, আপনি স্পষ্ট করিয়া কথা বলুন, আপনি যে বলিলেন আপনি নাগসেন বলিয়া জ্ঞাতএই নাগসেন এখানে কে? আপনার মাথার চুলগুলি কি নাগসেন?

নাগসেন উত্তর করিলেন, 'না মহারাজ।'

তবে কি আপনার লোম, নখ, দন্ত, ত্বক্, মাংস প্রভৃতির কোনটি নাগসেন?'

উত্তর হইল –‘না।'

তবে কি রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার, বিজ্ঞান এই পঞ্চস্কন্ধ নাগসেন?'

উত্তর হইল– 'না'

তবে কি মহাশয়, এই রূপ, বেদনাদি পঞ্চস্কন্ধের সমষ্টি হইল নাগসেন?'

তাহাও নয়।'

তখন বিভ্রান্ত রাজা বলিলেন, 'হে ভদন্ত নাগসেন, আমি আপনার নিকটে নাগসেন কে, নাগসেন কে জিজ্ঞাসা করিতে করিতে নাগসেনকে আর কোথাও দেখিতে পাইলাম না। তবে কি নাগসেন একটা শব্দ মাত্র? নাগসেন তাহা হইলে অলীকমিথ্যা, — নাগসেন বলিয়া কোথাও কোনও কিছুই নাই।'

বৃদ্ধ ভিক্ষু নাগসেন মহারাজ মিলিন্দের মনোভাব বেশ বুঝিতে পারিলেন। মহারাজ মিলিন্দ এখানে তৎকালীন সংশয়াচ্ছন্নচিত্ত সাধারণ জনসমাজেরই প্রতিনিধি। নাগসেন বুঝিতে পারিলেন, বিশুদ্ধ তর্কের দ্বারা বিষয়টি মহারাজ মিলিন্দকে বুঝান যাইবে না; তাই তিনি একটি চমৎকার দৃষ্টান্তের সাহায্যে বিষয়টি বুঝাইয়া দিবার চেষ্টা করিলেন।

তিনি বলিলেন, ‘মহারাজ, আপনাকে দেখিয়া মনে হইতেছে, আপনি কোনও ক্ষত্রিয় কুমার, সুকোমল আপনার দেহ; এখন মধ্যাহ্ন বেলা, ভূমি তপ্ত হইয়া গিয়াছে, উষ্ণ বালুকার উপরে তীক্ষ্ণ কাঁকর এবং ভগ্ন মৃৎপাত্রএই সমূহ আপনি আপনার কোমল পায়ে মর্দিত করিয়া আসিয়াছেন; সম্ভবতঃ আপনার চরণ উপহতদেহও বোধ হয় আপনার ক্লান্ত।' - কথা শুনিয়া মিলিন্দ বলিলেন, — 'না, আমি পায়ে হাঁটিয়া আসি নাই, আমার রথে চড়িয়া আসিয়াছিআমার কিছুমাত্র ক্লান্তি হয় নাই। কথাটি শুনিয়াই নাগসেন বলিলেন, 'বেশ কথা, আপনি যদি রথে চড়িয়া আসিয়া থাকেন তবে এই রথ বস্তুটি কি জানিবার জন্য আমার বড় আগ্রহ। বলুন রথ কি?— ঈশ, অর্থাৎ সামনের লম্বা দণ্ডটিই কি রথ?

রাজা বলিলেন, – ’না মহাশয়।

নাগসেন জিজ্ঞাসা করিলেন, “তবে অক্ষ (রথচক্রের মধ্যমণ্ডল), অথবা চক্র, অথবা পঞ্জর, দণ্ড, যুগ, রজ্জু, প্রতোদ- দণ্ড প্রভৃতির কোনটি কি রথ?’

মিলিন্দ বলিলেন, — 'না, ইহার কোনটিই রথ নয়।'

তবে কি এইগুলির সমষ্টি হইল রথ?'

তাহাও নয়।'

এইবারে নাগসেন বলিলেন, — “মহারাজ, আপনি যেমন জিজ্ঞাসা করিয়া জিজ্ঞাসা করিয়া শেষ পর্যন্ত নাগসেনকে কোথাও দেখিতে পান নাই, আমিও তেমনই জিজ্ঞাসা করিয়া জিজ্ঞসা করিয়া কোথাও রথ দেখিতে পাইলাম না। আমিও তবে আপনার ন্যায় বলিতে পারি, রথ একটি শব্দমাত্র, রথ একান্তই একটি মিথ্যাএকটি অলীক পদার্থএখানে রথ বলিয়া কোন বস্তুই নাই।

রাজা তখন বলিলেন, — 'না, আমি মিথ্যা বলি নাই;— রথ একেবারে মিথ্যা বস্তু নয়; ঈশ, চক্র, অক্ষ প্রভৃতি সমুদায়ের সমবায়ে সকলের সুসম্বদ্ধতা দ্বারা রথ বলিয়া একটি প্রতীতি জাগ্রত হয়; ইহা প্রতীতি বা সংজ্ঞামাত্রইহা একটা ব্যবহার নাম মাত্র।'

তখন নাগসেন উৎসাহিত হইয়া বলিলেন, বেশ বেশ মহারাজ, আপনি দেখিতেছি রথ কি তাহা বেশ ভাল করিয়াই জানেন। ঠিক এইভাবেই রূপ এবং বেদনা- সংজ্ঞা সংস্কার- বিজ্ঞান এই পঞ্চস্কন্ধের সমবায়েই জাগিয়া ওঠে একটি নাগসেনের প্রতীতি বা সংজ্ঞামাত্র। ইহা সম্পূর্ণ লোক- ব্যবহার বা নাম মাত্র, পরমার্থতঃ এখানে কোনও পৃথক ব্যক্তি- সত্তা বা অবয়বী- স্বরূপ লোক বা কোনও আত্মা উপলব্ধ হয় না।

এখানে দেখিতেছি, রথের কোনও অবয়বে বা তাহার সমগ্র অবয়বের সন্নিবেশের ভিতরেরথবলিয়া আসলে কোনও পৃথক বস্তু নাই, শুধু সমগ্র সন্নিবেশকে বুঝাইবার জন্য রথ একটি বস্তুহীন প্রতীতি বা লোকব্যবহার মাত্র ব্যক্তিপুরুষ বা আত্মাও আমাদের পঞ্চস্কন্ধের সন্নিবেশকে বুঝাইবার জন্য একটা নাম মাত্র।

আসলে আমরা দেখিতে পাই, বহির্বিশ্বে আমাদের পূর্ববর্তী গাছের দৃষ্টান্তে বা নদীর দৃষ্টান্তে যেমন কেবল একটি সত্তা- সন্ততি মাত্র রহিয়াছে, প্রাণীর ক্ষেত্রে বিশেষ করিয়া মানুষের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র একটি সত্তা- সন্ততিই নাইতাহার সঙ্গে সঙ্গে একটি বিজ্ঞান- সন্ততি (বিজ্ঞান অর্থে এখানে চেতনা) রহিয়াছে। এই যে আমাদের বিজ্ঞান- সন্ততি সে প্রতি মুহূর্তে পৃথক্ হইয়াও স্মৃতির ভিতর দিয়া একটা ঐক্যরূপে প্রতীত হয়।

সেই প্রতীতি হইতেই জাগে আমাদের ব্যক্তিপুরুষ বা আত্মার কল্পনা; বৌদ্ধগণের মতে সে ব্যক্তিপুরুষ বা আত্মা আমাদের কল্পনাই মাত্রআর কিছুই নহে।

ইন্দ্রিয়ানুভূতি এবং তজ্জনিত জ্ঞানের ক্ষেত্রে সাধারণভাবে হিন্দুধর্মের বিশ্বাস এই, অন্তর্যামী পরমাত্মাই একমাত্র বেত্তাইন্দ্রিয়গুলি বিষয়গ্রহণের দ্বার মাত্র। চক্ষুর ভিতর দিয়া সেই বেত্তা আত্মাই দেখেন, কর্ণের ভিতর দিয়া তিনি শোনেন, নাসিকার ভিতর দিয়া তিনি ঘ্রাণ গ্রহণ করেন। এই ভাবটি অবলম্বন করিয়াইকেন- উপনিষদে' বলা হইয়াছে

শ্রোত্রস্য শ্রোত্ৰংমনসো মনো যদ্বাচো বাচং প্রাণস্যপ্রাণ শ্চক্ষুষশ্চক্ষুঃ।

তিনিই হইলেন শ্রোত্রের শোত্র, মনের মন, বাক্যের বাক্য, প্রাণের প্রাণ, চক্ষুর চক্ষু।'

কিন্তু বৌদ্ধগণ ইন্দ্রিয়াদির পশ্চাতে এই বেত্তা বলিয়া কোনও কিছু স্বীকার করেন না।মিলিন্দপঞহোতে নাগসেনকে রাজা মিলিন্দ জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, – 'বেদগূউপলব্ধ হন কি না। নাগসেন রাজাকে বলিলেন, ‘বেদগূ' নামে সে আবার কে মহারাজ? মিলিন্দ বলিলেন,-

যো ভন্তে, অবভন্তরে জীবো চক্খুনা রূপং পস্সতি, সোতেন সদ্দং সুনাতি, ঘাণেন গন্ধং ঘায়তি, জিহায় রসং সায়তি, কায়েন ফোট্ঠব্বং ফুসতি, মনসা ধম্মং বিজানাতি।

অর্থাৎ, 'অভ্যন্তরে এই যে জীব, যে চক্ষু দ্বারা রূপ দেখে, শ্রোত্রের দ্বারা শব্দ শোনে, ঘ্রাণের দ্বারা গন্ধ গ্রহণ করে, জিহ্বা দ্বারা রস আস্বাদন করে, কায়ের দ্বারা স্পর্শনীয় বস্তু স্পর্শ করে, মনের দ্বারা ধর্মকে বিশেষভাবে জানে।' এই বিশ্বাস সেই ঔপনিষদিক ধর্মেরই বিশ্বাস। আমরা প্রাসাদের মধ্যে থাকিয়া যেমন সবদিকের বাতায়নগুলি খুলিয়া দিয়া সব বাতায়নপথেই বাহিরের দৃশ্যকে গ্রহণ করিতে পারি, অভ্যন্তরস্থ বেত্তাও তেমনই ইন্দ্রিয়দ্বারে সব কিছু দেখিতে পান।

ইহার জবাবে নাগসেন যে প্রতিপ্রশ্নসমূহ দ্বারা রাজাকে নিরস্ত করিতে চাহিয়াছিলেন তাহার তাৎপর্য এই যে, ইন্দ্রিয়গুলি যদি অভ্যন্তরস্থ বেত্তার বিষয়গ্রহণ নিমিত্ত দ্বারমাত্র হইত তবে বেত্তা ইচ্ছা করিলে যে কোনও দ্বারপথে বিষয়াদিকে দর্শন, শ্রবণ, আঘ্রাণ আস্বাদন এবং স্পর্শন করিতে পারিতেন। কিন্তু বেত্তার পক্ষে তাহা যখন সম্ভব হয় না তখন বুঝিতে হইবে দর্শন ক্রিয়া চক্ষুদ্বয় এবং রূপাদির উপরেই নির্ভর করে, শ্রবণ ক্রিয়া কর্ণদ্বয় বহিঃশব্দাদির উপরেই নির্ভর করে,– আঘ্রাণ, আস্বাদন এবং স্পর্শনাদির ক্ষেত্রেও তাহাই। সুতরাং ইহার ভিতর আবার বেত্তারূপ কোনও আত্মা স্বীকার করিবার প্রয়োজনই করে নাসেই বেত্তাপুরুষ আমাদের বিকল্পমাত্র।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

buttons=(Accept !) days=(20)

আমাদের ওয়েবসাইট আপনার অভিজ্ঞতা উন্নত করতে কুকিজ ব্যবহার করে। দয়া করে সম্মতি দিন। Learn More
Accept !