আনন্দ স্থবির ছিলেন ভগবান বুদ্ধের প্রধান সেবক। তিনি রাজকুমার সিদ্ধার্থের কাকাতো ভাই ছিলেন। তাঁর পিতার নাম অমিতোদন, মাতার নাম জনপদ কল্যাণী। তাঁর জম্ম গ্রহনের সময় জ্ঞাতি বর্গের অন্তরে বিশেষ আনন্দ উৎপন্ন হওয়ায় তার নাম রাখা হয় আনন্দ। ভগবান বুদ্ধ সম্যক সম্বোধি লাভ করে ধর্ম চত্রু প্রবর্তন করার পর যখন কপিলা বস্তুতে উপস্থিত হন, সে সময় ভদ্রিয়, অনুরুদ্ধ, ভৃগু, কিম্বিল, দেব দত্ত প্রমূখ শাক্য রাজ কুমারদের সাথে আনন্দ স্থবিরও বুদ্ধের নিকট প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন।
বৌদ্ধ ধর্ম রক্ষায় আনন্দের ভূমিকা অপরিসীম। তাঁর এই অসাধারণ অবদানের জন্য আমরা বৌদ্ধ জাতি আজ ধন্য। তিনি শুধু বৌদ্ধ সংগীতিতে যোগ দান করে বৌদ্ধ ধর্মকে সংরক্ষণ করেননি। বুদ্ধকেও যে ভাবে শ্রদ্ধা ও নিষ্ঠার সাথে সেবা বা রক্ষা করেছেন সত্যিই অতুলনীয়।
ভগবান বুদ্ধ যখন ৫৫ বৎসর বয়সে পদার্পন করেন, তখন একজন স্থায়ী সেবকের
প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তখন ভিক্ষু সংঘের মধ্যে বির্তক সৃষ্টি হয়, কে হবেন বুদ্ধের সেবক।
সারিপুত্র, মৌদ্গল্লায়ান এবং আনন্দসহ অনেকেই বুদ্ধের সেবক হতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। অবশেষে আনন্দ বুদ্ধের নিকট আটটি শর্তে র্প্রাথনা করে স্থায়ী সেবক পদে নিযুক্ত হন। বুদ্ধ
জানতেন, আনন্দ কল্পকাল ধরে এই পদের জন্য পুণ্য সঞ্চয় করে আসছেন।
আনন্দের ৮টি শর্ত-
- ১. বুদ্ধের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত উত্তম চীবর বুদ্ধ কখনো তাঁকে প্রদান করবেন না।
- ২. বুদ্ধের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত উত্তম আহার্য বুদ্ধ কখনও তাকে প্রদান করবেন না।
- ৩. বুদ্ধের শয়ন কক্ষে তিনি অবস্থান করবেন না।
- ৪. বুদ্ধের ব্যক্তিগত নিমন্ত্রণে তিনি সহগামী হবেন না।
- ৫. বুদ্ধের পক্ষে আনন্দ কর্তৃক গৃহীত নিমন্ত্রণে বুদ্ধের সম্মতি থাকতে হবে।
- ৬. বুদ্ধের দর্শন প্রার্থী দুরাগত ব্যক্তিকে বুদ্ধের নিকট নিতে পারবেন।
- ৭. তাঁর ইচ্ছানুসারে সময়ে তিনি বুদ্ধের সাথে সাক্ষাৎ করতে পারবেন।
- ৮. তাঁর অবর্তমানে বুদ্ধ যে সব ধর্ম দেশনা করবেন সে একই দেশনা তাঁর কাছে বুদ্ধ পূনঃ বার দেশনা করতে হবে।
আয়ুম্মান আনন্দ দীর্ঘ ২৫ বৎসর কাল আন্তরিকভাবে ঐকান্তিক শ্রদ্ধা ও নিষ্ঠার সাথে বুদ্ধের সেবা করেছিলেন। পরিনির্বাণ শষ্যায় শায়িত স্বয়ং তথাগত বুদ্ধ আনন্দকে সম্বোধন করে ভিক্ষুসঙ্ঘের উদ্দেশ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ দিয়েছেন। আনন্দের গুরুসেবার মাহাত্ম ঘোষণা করে বুদ্ধ বলেন, আনন্দ তুমি দীর্ষকাল আমার সেবক হিসেবে অবস্থান করেছ, দীর্ঘকাল প্রেমপূর্ণ হিত সুখকর দ্বিধাভাব রহিত অপরিমেয় কায়িক, বাচনিক, মানসিক কর্ম দ্বারা আমার পরিচর্যা করেছ। আনন্দ তুমি কৃত পূণ্য সাধনে একনিষ্ঠ হও, অচিরে তুমি আসবক সমূহ হতে মুক্ত হবে। ভগবান বুদ্ধ আরও বললেন- আমি যেমন আনন্দকে সেবক রুপে লাভ করেছি, অতীতের বুদ্ধগণও সেরুপ সেবক লাভ করেছেন এবং ভবিষ্যতে যে সব বুদ্ধ উৎপন্ন হবেন তারাও এরুপ সেবক লাভ করবেন।
আনন্দকে
দেওয়া এসব উপদেশ মহাপরিনির্বাণ সূত্রেও পাওয়া যায়। আনন্দ থের অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে
বুদ্ধের সেবা করতেন। বুদ্ধ যখন উপদেশ দিতেন, তিনি অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে শুনতেন।
সব উপদেশ মনে রাখতেন। তার স্মৃতিশক্তি ছিল খুবই প্রখর। আনন্দ একজন ভালো বক্তা ছিলেন।
তিনি বুদ্ধের যেকোনো উপদেশ প্রয়োজনে হুবহু অন্যকে বলতে পারতেন। এ জন্য তিনি ধর্মভাণ্ডারিক
ও শ্রুতিধর ভিক্ষু নামে খ্যাত হন।
বুদ্ধের
মহাপরিনির্বাণ লাভের অল্পকাল পরেই রাজগৃহের সপ্তপরণী গুহায় প্রথম মহাসঙ্গীতি অনুষ্ঠিত
হয়। মহাসংগীতিতে একমাত্র অর্হৎ ভিক্ষুদেরই প্রবেশাধিকার ছিল। তবে বুদ্ধের সেবক ও শ্রুতিধর
হিসেবে আনন্দের জন্য একটি আসন সংরক্ষিত ছিল। এ আমন্ত্রণ পেয়ে আনন্দ মহাসংগীতির পূর্বরাতে
গভীর ধ্যানে নিমগ্ন হলেন। সেই রাতেই তিনি অইত্ব ফলে উন্নীতি হন। অর্হত্ব লাভ করে তিনি
ভিক্ষুদের অনেক উপদেশ প্রদান করেন। নিম্নে দুটি উপদেশ তুলে ধরা হলো:
- ১। কর্কশ বাক্যভাষী, বক্রোধী, অহংকারী এবং সংঘভেদকারী ব্যক্তির সঙ্গে কন্ধুত্ব করবে না, তাদের সঙ্গী হওয়া উচিত নয়।
- ২। শ্রদ্ধাবান, শীলবান, জ্ঞানবান ব্যক্তির সঙ্গে কন্ধুত্ব করবে। তাঁদের সঙ্গ উত্তম।
তথাগত সম্যক সম্বুদ্ধের পরিনির্বানের পর হতে প্রথম সংগীতি অধিবেশনের পূর্বদিন পর্যন্ত আনন্দ শৈক্ষ্য অবস্থায় অতিক্রম করে সিদ্ধি লাভ করতে পারেননি। এদিকে ভিক্ষুরা তাঁকে সংগীতিতে যোগদানের জন্য নিমন্ত্রণ পাঠিয়েছেন। আনন্দ চিন্তা করলেন আমি এখনও তো অসিদ্ধ অবস্থায় আছি, আমার পক্ষে সংগীতিতে উপস্থিত হয়ে ধর্ম সংঘায়ন করা কি উচিত হবে; তিনি সংগীতিতে যোগদান করবেন না বলে, স্থির করলেন। বৌদ্ধশাস্ত্রে কথিত আছে, আনন্দ ঐ রাতে অর্থাৎ প্রথম সংগীতি আরম্ভ হওয়ার পূর্বরাত্রে দেবগণ কর্তৃক বিশেষভাবে উৎসাহিত হয়ে কর্মস্থান ভাবনায় রত হলেন। দীর্ঘরাত্রি পর্যন্ত চংক্রমনে বিদর্শন ভাবনা করতে করতে শেষযামে যখন শ্রান্ত ক্লান্ত দেহে একটু বিশ্রামের জন্য শষ্যাগ্রহণ করতে লাগলেন, যখন পাদদ্বয় ভূমি হতে তুলে মঞ্চোপরি উপাধানে মস্তক স্থাপন করে শয়ন করবেন এমন সময় হঠাৎ তার অন্তরাকাশ দিব্য আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে গেল। তিনি বহু আকাংক্ষিত অর্হত্ব ফলে প্রতিষ্ঠিত হলেন।
এদিকে
মহাসংগীতি উপলক্ষে সম্মেলনকক্ষে সকল অর্হৎ ভিক্ষু সমবেত হন। শুধু আনন্দ থের ছিলেন অনুপস্থিত।
মহাসঙ্গীতি শুরু হলো। হঠাৎ সকলেই দেখলেন আনন্দ তাঁর আসনে বসে আছেন। সকলের মন খুশিতে
ভরে উঠল। কথিত আছে, তিনি আকাশপথে এসে তাঁর জন্য রাখা নির্দিষ্ট আসন গ্রহণ করেছিলেন।
সংগীতি মন্ডপে পঞ্চশত ভিক্ষু পুরিপূর্ণ হল, তারা সবাই ষড়াভিজ্ঞা অর্হৎ বুদ্ধের দেশিত ধর্ম-বিনয়ে সুদক্ষ ছিলেন। সমবেত ভিক্ষু মন্ডলী সর্ব সম্মতিক্রমে উপালিকে প্রথমে বিনয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। তারপর মহাকাশ্যপ স্থবির আনন্দকে ধর্ম সম্পর্কে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন। আনন্দ নিপুন কন্ঠে যথাযতবাবে প্রত্যেক প্রশ্নের উত্তর প্রদান করলেন। এভাবে সূত্রাদি সঙ্গে অভিধর্মও চয়ন করা হল। এভাবে ধর্ম-বিনয় সাতমাসে সংগ্রহ হয়েছিল।
ভিক্ষুণী
সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠায় আনন্দের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। মহারাজ শুদ্ধোদনের মৃত্যুর পর মহাপ্রজাপতি
গৌতমী বুদ্ধের কাছে গিয়ে প্রব্রজ্যা গ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু বুদ্ধ প্রথমে
এতে সম্মত হননি। পরে আনন্দের প্রবল অনুরোধে নারীদেরও সঙ্ঘ প্রবেশাধিকার অনুমোদন করেন।
সে
সময়ে নারীদের ভিক্ষুণী পদের মর্যাদা প্রদান করা খুবই কঠিন ছিল। নারীদের গৃহে থাকাই
ছিল সামাজিক প্রথা। তাই বলা হয়, মাতৃজাতিকে ধর্মীয় ক্ষেত্রে মর্যাদাপূর্ণ স্থানে প্রতিষ্ঠিতকরণে
আনন্দ থের’র ভূমিকা ছিল অপরিসীম।
তিনি
১২০ বৎসর বয়সে রোহিনী নদীর মাঝখানে শূন্যকাশে মহাপরিনির্বাণ রাভ করেন।
আমাদের কমেন্ট করার জন্য ধন্যবাদ। আমরা আপনার কমেন্ট পড়া মাত্র প্রতিক্রিয়া জানাতে চেষ্টা করবো।