বাংলাদেশের ইতিহাসে জাতিসত্তা হিসেবে বৌদ্ধরা অতি প্রাচীন। ভারত-বাংলা উপমহাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বিনির্মাণে বৌদ্ধদের অসামান্য অবদান রয়েছে। এদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামসহ প্রতিটি প্রগতিশীল আন্দোলন-সংগ্রামে বৌদ্ধদের গৌরবময় ইতিহাস লক্ষ্য করা যায়।
দেশ বিভাগের ফলে বৌদ্ধদের বিরাট অংশ পূর্ববঙ্গে রয়ে গেল। তাঁরা মাতৃভূমির সর্ববিধ উন্নতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করলেন। দেশের প্রশাসনিক ব্যাপারেও তাঁদের যোগ্য স্থান ছিল। কেউ কেউ রাজ্যসভা ও বিধানসভা সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন এবং মন্ত্রীপদে অধিষ্ঠিত হয়ে যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন। দেশের সুখ-দুঃখ, সম্পদে-বিপদে বৌদ্ধরা সমান অংশগ্রহণ করে যান। ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষা আন্দোলনে বহু কৃতি ছাত্র ছাত্রী ও বুদ্ধিজীবি সহযোগিতা ও নেতৃত্ব দিয়ে ইহাকে সাফল্যমন্ডিত করেছেন।
এদেশের বৌদ্ধ সম্প্রদায় বিশেষ করে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধদের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় সাহসী কর্মনির্মিতি ছিল অনন্য অসাধারণ। বাংলার ভূমিজ সন্তান হিসেবে বৌদ্ধরা দেশমাতৃকার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে মুক্তি সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বৌদ্ধ সম্প্রদায় বলতে বাঙালি বডুয়া বৌদ্ধ, পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর চাকমা, মারমা, রাখাইন, মুরং, চাক, তনচঙ্গ্যা প্রভৃতি জনগোষ্ঠীকে বুঝায়। বৌদ্ধরা জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সকলেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন এবং বীরত্বপূর্ণ ও সাহসী ভূমিকা পালন করেন। তাদের অনেকেই জীবন দিয়েছেন। বাংলাদেশের মানুষের উপর পাকবাহিনীর অতর্কিত বর্বরোচিত আক্রমণে এদশের মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সকলেই অত্যাচার, নির্যাতিত, নিপীড়িত, ধর্ষণ ও নৃশংসভাবে নিহত হয়েছেন।
১৯৭০ সালে নির্বাচনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ ছয় দফা দাবীর ভিত্তিতে যে ছয় দফা আন্দোলন শুরু করে সেই দাবীগুলিতে অন্ধ সাম্প্রদায়িকতা ছিল না। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলের সমান অধিকার স্বীকৃত হয়েছিল। সেই কারণে দেশের প্রগতিশীল বিরাট অংশ আওয়াগী লীগকে সমর্থন করেন। বাংলার বৌদ্ধেরাও এই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। চট্টগ্রামের রাউজান থানা বৌদ্ধ প্রধান অঞ্চল। এখানে মুসলিম লীগের কিছু ব্যক্তিও আছেন তাঁরা মুসলীম লীগ সমর্থনের জন্য বৌদ্ধদেরকে নানাভাবে পরোচিত ও ভয় প্রদর্শন করতে থাকে। বৌদ্ধেরা দৃঢ়তার সাথে ইহার প্রতিবাদ করেন এবং আওয়ামীলীগ সমর্থন করেন। ফলে নির্বাচনের প্রাক্কালে গুজরা নয়াপাড়ার কয়েকখানি বৌদ্ধ গ্রাম আক্রান্ত হয়। এই সংঘর্ষের ফলে দুইজন বৌদ্ধ নিহত ও কয়েকজন আহত হন। অপর পক্ষেও কিছু হতাহত হয়েছে। শেখ মুজিবর রহমানের কাছে এই সংবাদ পৌঁছলে তিনি সহসা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন এবং নয়াপাড়া উচ্চ ইংরেজি স্কুল মাঠে বিরাট জনসভায় ঘোষণা করেন যে, বাংলাদেশ শুধু মুসলমানের নয়, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানেরও নয়; বাংলাদেশ জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র বাঙালির। নির্বাচনে বিপুল ভোটাধিক্যে আওয়ামী লীগপন্থীরা সর্বত্র জয় লাভ করেছেন। আর মুসলীম লীগপন্থীদের শোচনীয় পরাজয় ঘটে। ইহাতে মুসলীম লীগপন্থীদের অমুসলিম বিদ্বেষ আরো বৃদ্ধি পায়।
২৫শে মার্চ ১৯৭১ সন হতে বাঙালিদের উপর যে জঙ্গীশাহী আক্রমণ হয়েছে, তাতে প্রথম জাতি ধর্ম নির্বিশেষে নিধন কার্য চালায়। পরে সুপরিকল্পিতভাবে হিন্দু বৌদ্ধ ও আওয়ামীলীগ সমর্থকদের ধ্বংস করা হয়েছে। অপ্রস্তুত অবস্থায় বহু সংখ্যক বাঙালি এই আক্রমণে হতাহত হয়েছে। মা-বোন মাতৃজাতিরা ধর্ষিত ও লুন্ঠিত হয়েছেন। ইতিমধ্যে বাঙালিরা আত্মরক্ষার্থে মুক্তিবাহিনী গঠন করে পাক সৈন্যদের অগ্রগতি রোধ করেন। এই বাহিনীতে বৌদ্ধ তরুণ-তরুণীরা প্রচুর পরিমাণে যোগদান করেন। মুক্তিবাহিনীর প্রচন্ড আক্রমণের ফলে বাংলাদেশের বৃহত্তর অংশ এখন শত্রুর কবল মুক্ত হয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বৌদ্ধদের মধ্যে স্বদেশে সংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথের এবং বিদেশে পন্ডিত জ্যোতিঃপাল মহাথের প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৌদ্ধ রাষ্ট্র জাপান, থাইল্যান্ড, কোরিয়া, শ্রীলংকা, কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশসমূহ সফরপূর্বক মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করেন।
পন্ডিত জ্যোতিঃপাল মহাথের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরিস্থিতি ও ভয়াবহতা বিষয়ে ভারতের আগরতলায় ১৯৭১ সালের ২২ এপ্রিল সকাল ১০ টায় একটি জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলন করেন। সংবাদ সম্মেলনে বৌদ্ধ নেতৃবৃন্দ, ভারত সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা- শ্রী গোপাল ভূষণ চাকমাসহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন। এ সময় আকাশবাণী, আনন্দবাজার, যুগান্তর এবং অন্যান্য আঞ্চলিক গণমাধ্যমের সাংবাদিকগণ উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, “পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কর্তৃক বাঙালি বৌদ্ধদের উপর নৃশংস অত্যাচার, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, বাড়ি-ঘরে অগ্নিসংযোগ ও গণহত্যা পরিচালিত হয়। পরবর্তীতে তিনি ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শ্রী শচীন্দ্র লাল সিংহ, অর্থমন্ত্রী শ্রী কৃষ্ণ দাস ভট্টাচার্য এবং মুখ্যসচিব ও অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে স্বাক্ষাৎকারে মক্তিযুদ্ধের দুঃখজনক ইতিহাস তুলে ধরেন।
এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে তিনি জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট, বিশ্ব বৌদ্ধ সৌভ্রতৃত্ব সংস্থা-ব্যাংককের সভাপতি রাজপুত্র পুন-পিসমাই-দিসকুল এবং মহাসচিব মি. ইয়েম সংঘবাসী, শ্রীলংকার রাষ্ট্রপতি শ্রীমাভো বন্দর নায়েক, বিশ্ব বৌদ্ধ সৌভ্রাতৃত সংস্থার সকল আঞ্চলিক কেন্দ্র এবং বৌদ্ধ পরিষদে বাংলাদেশে নৃশংস গণহত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনের রিপোর্ট প্রেরণ করেন।”
পন্ডিত জ্যোতিঃপাল মহাথের উল্লেখ করেন যে, `Moveover, the last day I and Mr. K M Shahabuddin went to Parliament house to meet with Ministers and Members of the Parliament presented the exact scene about the success in freedom of occupied Bangladesh and made an application to stop the landing of Pakistani flight in Sinhala Airport. As a result, Srilankan Prime Minister Mrs. Bander Nayek to stop the landing of Pakistani flight in Colombo Airport. All directions such as north south, east west, and water-land-air were closed for Pak occupied force. `
মুক্তিবাহিনীকে প্রতিহত করার নিমিত্ত জঙ্গী নেতারা নির্বাচনে পরাজিত মুসলিম লীগের সহায়তায় সমাজ বিরোধী লোকদেরকে নিয়ে রাজাকার বাহিনী গঠন করেছেন। তাদের হাতে অস্ত্রশস্ত্র দেওয়া হয়েছে। এই রূপে বাঙালিদের মধ্যে পরস্পর বিভেদ সৃষ্টি করেছে জঙ্গীশাহীরা শাসন ও শোষণ অক্ষুণ রাখার পরিকল্পনা করেছেন। ফলে সাত মাসে প্রায় দেড় কোটি বাঙালি হতাহত ও শরণার্থীরূপে ভারতে আশ্রিত হয়েছেন। তথাকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সমূহ একেবারে নিশ্চিহ্ন হবার উপক্রম হয়েছে। বহু গ্রামে ও মন্দিরের বিপন্ন হিন্দু মুসলমানদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছে এবং সুযোগ মত নিরাপদ স্থানে প্রেরিত হয়েছে সেজন্য রাজাকার ও পাক সৈন্যের সম্মিলিত আক্রমণে বহু বৌদ্ধ গ্রাম ধ্বংস হয়েছে।
চট্টগ্রাম পটিয়া থানার সাতবাড়িয়া গ্রাম ও শান্তি বিহার আক্রান্ত ও লুন্ঠিত হয়েছে। জোয়ারা, সুচিয়া প্রভৃতি গ্রামও লুণ্ঠিত হয়েছে। এই রূপে ফটিকছড়ি, হাটহাজারী, রাঙ্গুনিয়া, পটিয়া, সাতকানিয়া, সীতাকুন্ড ও মিরেরশ্বরাই থানার বৌদ্ধ বিহার ও গ্রাম বিধ্বস্ত ও লুন্ঠিত হয়েছে। কক্সবাজার, রামু, উখিয়া, চকরিয়া হারবাং, মহেশখালির বিহারও আক্রাস্ত ও লুণ্ঠিত হয়েছে। বুদ্ধমূর্তি ভগ্ন করা হয়েছে। অষ্টধাতুর বড় বড় বুদ্ধমূর্তি চুর্ণ-বিচুর্ণ করে লুন্ঠিত হয়েছে। বহুধর্মগুরু ও নর-নারী হতাহত হয়েছেন। এই সংগ্রামে অন্তত পঁচিশ সহস্র বৌদ্ধ নিহত ও লক্ষাধিক প্রতিবেশি রাষ্ট্রে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছেন।
যতই সময় যাচ্ছে সংখ্যালঘু বৌদ্ধরা প্রায় নিশ্চহ্ন হতে চলেছে। তথাপি বৌদ্ধ তরুণগণ দলে দলে মুক্তি বাহিনীতে যোগদান করে মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করার নিমিত্ত আত্মনিয়োগ করছেন। শরণার্থী রূপে ভারতে গিয়ে বহু বৌদ্ধ তরুণ পুন মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করেছেন। বহু তরুণের সম্মুখ সংগ্রামে শত্রু নিধন করে শহীদের গৌরব অর্জনের করেছেন। তথাপি বহু যোদ্ধা সংগ্রাম চালিয়েছেন অসীম সাহসে। অনেক স্বেচ্ছাসেবী তরুণ বীর সৈনিক রূপে মুক্তি সংগ্রামে প্রবেশ করেছেন।
ধর্মাধার মহাস্থবির উল্লেখ করেছেন, ‘চট্টগ্রামের সাতবাড়িয়া গ্রামের শান্তি বিহার পাক সৈন্যরা গত আগস্ট মাসে লুঠ করে বিহারের মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে যায় এবং বৌদ্ধদের ধর্মগুরু সংঘনায়ক শ্রদ্ধেয় অভয়তিষ্য মহাস্থবিরের উপর অকথ্য নির্যাতন চালায়। এই রকম ঘটনা বাংলাদেশে পাক জঙ্গীশাহীর আমলে শত শত ঘটিয়াছে।’ তিনি আরো লিখেছেন, ”বাংলাদেশের বিজয়ে বাঙালি হিসাবে আজ আমরাও গর্বিত এবং সেই দেশের আনন্দযজ্ঞে আমরাও অংশীদার কারণ এই যুদ্ধ শুধু যুদ্ধ জয় কিংবা রাজনৈতিক জয় না, ইহা জয় নয়; মানবিকতার জয়, গণতন্ত্রের জয়, স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে সমাজতন্ত্রের জয়। তাই আমরা আনন্দিত।” দীর্ঘ পঁচিশ বছর ধরে পূর্ববঙ্গে অসহায় নিরীহ জনসাধারণের উপর পশ্চিম পাকিস্তানীদের ঘৃণ্য শোষণ আমাদের বার বার ব্যথিত করেছে। অসহায়ের মতো আমরা লক্ষ্য করেছি কেমন করে একটি প্রাণবন্ত জাতিকে নির্দয়ভাবে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। তাই ২৫শে মার্চ পাঁচ জঙ্গী শাসনের নৃশংস অত্যাচারের পর বৌদ্ধরা সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করেছিল বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মুক্তি সংগ্রামীদের সঙ্গে।
সেই সময় কলকাতায় বৌদ্ধদের মুখপত্র নালন্দার মাধ্যমে পাক শাসকদের বিরুদ্ধে ক্রোধ ও ঘৃণা এবং পূর্ববঙ্গের অসহায় নরনারীদের প্রতি সহানুভূতি জানিয়েছেন। নালন্দা পত্রিকার পঞ্চম বর্ষপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠানে এক প্রস্তাবে পূর্ববঙ্গের ইয়াহিয়া সরকার যে ধ্বংসলীলা চালায়া তার তীব্র নিন্দা করে জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব উ থান্টকে ঐ নরমেধ যজ্ঞের অবসান ঘটাতে অনুরোধ করা হয় এবং বিভিন্ন বৌদ্ধ ও মিত্র রাষ্ট্রের প্রধানদের পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টির জন্য অনুরোধ করা হয়।
তাছাড়া আগস্ট মাসে নয়াদিল্লীতে বাংলাদেশের সমস্যাসমূহ আলোচনা করার জন্য নিখিল ভারত বৌদ্ধ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ভারতের বিভিন্ন রাজ্য হতে প্রায় ৩০০জন প্রতিনিধি এই সম্মেলনে যোগদান করে বাংলাদেশের মুক্তিকামী সংগ্রামরত জনসাধারণের সমর্থনে এবং ইয়াহিয়া সরকারের জঘন্য বর্বরতার নিন্দা জ্ঞাপক পাঁচটি প্রস্তাব সভা সর্বস্মতিক্রমে গৃহীত হয়। বস্তুত বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম এপারের অগণিত বৌদ্ধদের প্রচন্ডভাবে উদ্দীপিত করেছে। তাই ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকায় পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের সংবাদে এখানকার বৌদ্ধরা আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠেন।
যুদ্ধের অব্যবহিত পরে থাইল্যান্ডের ব্যাংকক শহরে আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ যুব সংঘের সমগ্র এশিয়ার বৌদ্ধদের উপর অত্যাচার এবং বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের বিরুদ্ধে একটি নিন্দাসূচক প্রস্তাব গৃহীত হয়। ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর নিরাপদ প্রত্যাবর্তন ও বাঙালি বৌদ্ধদের পক্ষ হতে তাঁকে অভিনন্দন জানানো হয়।
বাংলার মুক্তি সংগ্রামে হিন্দু মুসলমানের ন্যায়স্থানীয় বৌদ্ধদের ভূমিকা খুবই গৌরবজনক। গোড়ার দিকে পাক ফৌজ জাতি ধর্ম নির্বিশেষে গণহত্যা চালিয়ে যায়। বৌদ্ধদেশ চীন পাকিস্তানের বন্ধু। চীন ও অপর বৌদ্ধদেশগুলো সৌহার্দ্য লাভের মানসে মাঝখানে পাক সৈন্যেরা বৌদ্ধদের ‘চাইনিস বুদ্ধিস্ট’ আখ্যা দিয়ে অত্যাচার হতে রেহাই দিতে চাইলে বৌদ্ধরা তার পুন সুযোগ গ্রহণ করলেন। প্রতিটি বৌদ্ধ গ্রাম বিপন্ন হিন্দু মুসলমানের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠল। এই সকল আশ্রয়স্থান হতে শরণার্থীদের সন্তর্পণে ভারতের দিকে প্রেরণ করা হয়। তাদের যাত্রাপথে মানিকছড়ির মানরাজ বাহাদুর সহস্র সহস্র শরণার্থী ও মুক্তিবাহনীর সেবার নিমিত্ত তার রাজকোষ উন্মুক্ত করে দেন। শরণার্থীরা নিরাপদে ত্রিপুরায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। বৌদ্ধ গ্রামগুলি মুক্তিবাহিনীর দুর্গে পরিণত হয়। এসব গ্রামে আত্মগোপন করে মুক্তিবাহিনী তাদের সংগ্রাম চালাতে থাকেন। দলে দলে বৌদ্ধ যুবক যুবতী মুক্তি বাহিনীতে যোগদান করে সংগ্রাম করেন।
দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়ার পর্বতবেষ্টিত অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে বৌদ্ধধর্মীয় নেতারা প্রত্যেক বৌদ্ধকে পরিচয় পত্র দেবার নির্দেশ দিলে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে সম্ভাব্য মৃত্যু হতে রক্ষার নিমিত্ত পরিচয়পত্র দিতে থাকেন। এই সুযোগে অনেক বৌদ্ধ পাক ফৌজের কোপ দৃষ্টি এড়িয়ে ভারতে চলে আসেন। দেশ দ্রোহীদের মাধ্যমে এই সংবাদ পাক সৈন্যদের নিকট পৌঁছলে আবার বৌদ্ধ গ্রামের উপর নিষ্ঠুর অত্যাচার চলতে থাকে। বহু ঘরবাড়ী ভস্মীভূত হয়, বৌদ্ধ বিহার লুণ্ঠিত ও ধ্বংস করা হয়। বহু বৌদ্ধ, ধর্মগুরু হতাহত ও নিখোঁজ হন। কিন্তু এই অত্যাচার বেশিদিন চলতে পারেনি ততদিনে পূর্ব পাকিস্তানে পতন ঘটেছে।
শরণার্থী ও ভারতীয় বৌদ্ধদের পক্ষ হতে স্বাধীন বাংলার স্বীকৃতি ও সাহায্যের নিমিত্ত ব্যাপক আন্দোলন চালায়। ভারতে অবস্থিত বৌদ্ধদেশগুলির কূটনৈতিক প্রতিনিধিদের মাধ্যমে বিশ্বের বৌদ্ধদেশগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। জাতিসংঘে দাবী করা হয়েছে। শরণার্থী বৌদ্ধ নেতা জ্যোতিঃপাল মহাথের প্রমুখ নেতৃবৃন্দ সিংহল, থাইল্যান্ড, জাপান, হংকং প্রভৃতি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৌদ্ধদেশগুলোতে প্রচার কার্য চালিয়েছেন। এই প্রচারের ফলে সেই সকল দেশবাসীর মানবীয় বিবেক জাগ্রত হয়েছে। বাংলাদেশে নৃশংস হত্যাকান্ডের নিমিত্ত পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে জনগণ সোচ্চার হয়েছে এবং স্বাধীন বাংলার প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করেছেন। মুক্তি সংগ্রামের সকল বিভাগে বৌদ্ধরা সক্রিয় ছিলেন। দীপ্তশপথ নেন জন্মভূমি শত্রু মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত এই সংগ্রাম করবেন। সকলের সমবেত প্রচেষ্টায় স্বাধীন বাংলা অচিরেই শত্রু মুক্ত হয়।
মুক্তিযুদ্ধকালীন পন্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবির লিখেছেন, হাটহাজারী থানার জোবরা গ্রাম পাক সেনাদের আক্রমণে বিপন্ন হয়েছে, বাড়ী ঘর লুণ্ঠিত ও এখানকার বিহারটি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। গোলার আঘাতে কয়েকজন নিহত হয়েছেন। অবশিষ্টেরা পলাতক। এর দুই মাইল দূর মিরথীন গ্রামেও একই অবস্থা। মির্জাপুর এক বর্ধিষ্ণু বৌদ্ধগ্রাম। একদিন অবাঙালি একদল লোক তথাকার হিন্দুদের বাড়ী ঘর লুট করে বৌদ্ধদের বাড়ীঘর লুট করতে থাকে। তারা পুরাতন শান্তিধাম বিহারের শ্বেত পাথরের বুদ্ধমূর্তি ভেঙ্গে ফেলে। তরুণগণ প্রবল বাধা দিলে দুবৃত্তরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। কয়েক ঘণ্টা পরে তারা হাটহাজারী হতে পাক সেনাদের সঙ্গে নিয়ে পুনরায় আক্রমণ করে। সৈন্যরা বিহারের একটি ঘর জ্বালিয়ে দেয়। এই সময় একজন প্রৌঢ় তথায় এসে তাদেরকে অনুরোধ করেন যে, তাঁরা পাকিস্তানের অনুগত প্রজা, তাঁদের উপর এই অত্যাচার কেন? বার্মার প্রধানমন্ত্রী উ. নূ’র সঙ্গে প্রেসিডেন্ট আয়ুব খানের এক বাঁধানো ছবি প্রদর্শন করেন। ইহাতে সৈন্যরা সন্তুষ্ট হন এবং বৌদ্ধদের উপর অত্যাচার না করার জন্য অবাঙালিদের নির্দেশ দেন। তখন হতে বৌদ্ধদের নিরাতঙ্কে থাকার আশ্বাস দিয়ে যান কিন্তু তার চার দিন পরে একদিন হঠাৎ সৈন্যসহ তারা গ্রামে লুঠতরাজ করে।
পরবর্তীতে রাউজান থানার গহিরা গ্রামের লুম্বিনী কানন বিহার পাক বোমায় ধ্বংস হয়েছে। রাঙ্গামাটি রোডের দুই পার্শ্বে বৌদ্ধদের বহু বাড়ি-ঘর ভস্মীভূত হয়েছে। কয়েকজন লোক মেশিন গানের গোলায় আহত ও নিহত হয়েছেন। পার্শ্ববর্তী বরজ্ঞান বিহার আক্রান্ত হয়েছে। বুদ্ধমূর্তিভগ্ন ও ভিক্ষুর উপর আঘাত করেছে, ভিক্ষু ও গৃহীগণ গ্রাম ত্যাগ করেছেন। এই সুযোগে মুসলিমলীগপন্থীরা বৌদ্ধদের গৃহপালিত পশুপাক্ষী ধান চাউল তৈজস পত্র লুঠ করেছেন, অনেক গৃহ জ্বালিয়ে দিয়েছেন।
হোয়ারাপাড়া সুদর্শন বিহার লুণ্ঠিত বুদ্ধমূর্তি ভেঙ্গে ফেলা হয়। বুদ্ধের পুতাস্থি অপহৃত হয়েছে। মহামুনি পাহাড়তলী গ্রামের পার্শ্বে কলেজে পাক সেনারা ঘাটি করেছে। গ্রামবাসী নির্যাতিত সতত সন্ত্রস্ত। একজন শিক্ষিত তরুণ ভিক্ষু পাক বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়। অনেক শিক্ষিত তরুণ ও বুদ্ধিজীবী দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়। পার্শ্ববর্তী রাঙ্গুনিয়ার সৈয়দবাড়ি, ইছামতি ও নজরের টিলার অনেক ঘর লুন্ঠিত ও ভস্মীভূত হয়েছে। লোকজন পাহাড়ে জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছে।
বোয়ালখালি থানার শাকপুরা গ্রামে দুইজন শিক্ষিত বৌদ্ধকে বিহারের বুদ্ধমূর্তির সম্মুখে হত্যা করা হয়। লোকের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেয়। পটিয়া, সাতকানিয়া থানার বহু শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত লোক হতাহত ও নিরুদ্দিষ্ট হয়েছেন। দক্ষিণ চট্টগ্রামের কক্সবাজার, রামু ও উখিয়া পালং অঞ্চলের অনেক বৌদ্ধ নিহত, গ্রাম লুণ্ঠিত ও ভস্মীভূত হয়েছে। প্রায় বিশ হাজার বাঙালি বৌদ্ধ আরাকানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তথায় মানবোচিত সৌজন্য অভাবে কিছু সংখ্যক ফিরে আসতে বাধ্য হন, কিন্তু স্থানীয় মুসলিম লীগের অত্যাচারে আবার তারা বাস্তুচ্যুত হন।
পন্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবির লিখেছেন, ঢাকা ট্রাঙ্ক রোডের পার্শ্বে সীতাকুন্ড, বারবকুন্ড, কাঠগড় ও পান্থশালা গ্রাম আক্রান্ত ও ভস্মীভূত হয়। গ্রাম ছেড়ে লোকজন পালিয়ে যান। মিরেরশ্বরাই থানার জোরারগঞ্জ ধ্বংস হয়। এখানে নারী নির্যাতনে অসম্মত বালুচ সৈন্যের সাথে পাঞ্জাবিদের সংঘর্ষ হয়। উভয় পক্ষে গুলি বিনিময় হয়। নোয়াখালী ও কুমিল্লা জেলার ১৮/২০ টি গ্রাম বিহারসহ আক্রান্ত হয়েছে। বহুলোক হতাহত, ভিক্ষুরা নির্যাতিত। অবশিষ্ট সহস্র লোক কোন প্রকারে প্রাণ নিয়ে ত্রিপুরায় আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। ঐ দুই জেলা একেবারে বৌদ্ধশূন্য হয়েছে। বরিশালে আদিবাসী রাখাইন বৌদ্ধদের উপর ভীষণ অত্যাচার-নির্যাতন করা হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা বৌদ্ধ প্রধান অঞ্চল। এর শতকরা ৯৭ ভাগ বৌদ্ধ ছিল। ইহার তিন পার্বত্য জেলায় তিনজন বৌদ্ধ রাজা রাজত্ব করেন। উত্তরে রামগড়ের মানরাজা পাকসেনার আক্রমণে ৬/৭ সহস্র উপজাতীয় প্রজাসহ ত্রিপুরায় শরণার্থী হয়েছেন। তাঁর রাজধানী মানিকছড়ি পাক সৈন্য অধিকার করেছেন। কিন্তু সামরিক কর্তৃপক্ষ চাকমা রাজাকে প্রলোভনে ভুলিয়ে প্রাক সামরিক তৎপরতা সমর্থন করান। দক্ষিণে বান্দরবানের বোমাং রাজা-প্রজা প্রায় পঞ্চাশ সহস্রের মত আরাকানে ও ভারেতে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছেন। পাক সৈন্যদের অমানুষিক অত্যাচারে পূর্ববঙ্গের প্রায় লক্ষাধিক বৌদ্ধ হত, আহত নিরুদ্দিষ্ট ও পলাতক হয়েছেন। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলের ওপর এই আক্রমণ চললেও সংখ্যালঘু বৌদ্ধ সমাজের অস্তিত্ব ভীষণভাবে বিপন্ন হয়েছে।
কক্সবাজার জেলার বৌদ্ধরা মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন ভাবে আক্রমণের স্বীকার হয়েছেন। অনেক বৌদ্ধ বাড়ি ও বিহারে পাকসেনারা আক্রমণ করেছে; বৌদ্ধ নারী-পুরুষ নির্যাতিত হন। এ সময় চকরিয়া, রামু, উখিয়া, মহেশখালী অঞ্চলের বহু বডুয়া ও রাখাইন বৌদ্ধ সক্রিয়ভাবে যুদ্ধ করেন আবার অনেকে নির্যাতনের ফলে ছেলে-মেয়ে-স্ত্রীসহ প্রাণভয়ে ব্রহ্ম দেশে আশ্রয় গ্রহণ করে।
সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা মূলত দুইটি দলে বিভক্ত ছিল। একটা হল এফ এফ (ফ্রীডম ফাইটার) মুক্তিবাহিনী, যারা প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রাধীন এবং মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এম এ জি ওসমানীর অনুগত বাহিনী আর অন্যটি হল বিএলএফ (বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স) মুজিববাহিনী নামে পরিচিত।
ড. প্রণব কুমার বডুয়ার মতে, মুক্তিযোদ্ধা চার প্রকারের-(ক) যারা ট্রেনিং নিয়ে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছিল, (খ) যারা দেশের অভ্যন্তরে থেকে ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছিল, (গ) যারা অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল, (ঘ) যারা ভারতে আশ্রয় নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপক্ষে মতামত সংগ্রহ এবং কাজ করেছিল।
সে হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা অনেক। তবে বিশিষ্ট কয়েকজনের কথা এখানে উল্লেখ করা হলো- বৌদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে রাউজান থানার লাঠিছড়ির নৃপেন্দ্র লাল বডুয়া (সম্মুখ যুদ্ধের অপারেশন এলাকা নোয়াখালী ও মিরেরসরাই), ডাবুয়ার অনিল বডুয়া (সম্মুখ যোদ্ধা), বাগেয়ানের জিনু বডুয়া, আবুরখীলের বোধিপাল বডুয়া (ফেনী বর্ডারের কাজ করতেন) ও নীতিশ বডুয়া (ইস্টার্ণ সেক্টরে মুজিব বাহিনীর প্রধান আব্দুর রবের নেতৃত্বে যুদ্ধ করেছেন), মিরেরসরাইয়ের বীর সিন্ধু বডুয়া (লে: রফিকের অধীনে যুদ্ধ করেন) ও সুকুমার বডুয়া (১নং সেক্টরের প্লাটুন কমান্ডার শরফুউদ্দীনের সাথে যুদ্ধ করেন) সুরঙ্গ গ্রামের ফণীন্দ্র লাল বডুয়া, সুনীল বডুয়া, বিপতী বডুয়া, হিঙ্গলার স্বপন বডুয়া, প্রদীপ বডুয়া, রাউজানের সন্তোষ বডুয়া সকলেই সম্মুখ যোদ্ধা ছিল এবং মেজর ছোবাহানের অধীনে যুদ্ধ করেন আনন্দ বডুয়া, ক্যাপ্টেন সুজিত আলী, সুযুর সিং গুলিয়া, লে: কর্ণেল কে কুমারের অধীনে সিলেটে যুদ্ধ করে।
এছাড়া জোবরার মতিলাল বডুয়া, গহিরার সুমঙ্গল বডুয়া, খৈয়াখালীর বীরেন্দ্র লাল বডুয়া, আব্দুল্লাহপুরের সম্বোধি প্রসাদ বডুয়া, বিপুল বডুয়া, কোঠেরপাড়ের ভারত বডুয়া, পদুয়ার অমিয় বডুয়া ও কল্যাণমিত্র বডুয়া, রাউজান থানায় এফ এফ গ্রুপ কমান্ডার আহসান উল্লাহ চৌধুরী এর অধীনে আলোজ্যোতি বডুয়া; এফ এফ গ্রুপ কমান্ডার মোহাম্মদ হাশেম এর অধীনে সুনীল বডুয়া; এফ এফ গ্রুপ কমান্ডার প্রভাকর বডুয়া। বোয়ালখালী থানার এফ এফ গ্রুপ কমান্ডার মো. মাহাবুবুল আলম, সদস্য শ্রীপুরের প্রশান্ত বডুয়া, জ্যেষ্ঠপুরার খোকা বডুয়া; বি এল এফ গ্রæপ কমান্ডার রাজেন্দ্র প্রসাদ চৌধুরী, সদস্য গোমরদন্ডীর শরৎ বডুয়া; ক্যাপ্টেন করিম এর নেতৃত্বাধীন কমান্ডার ডা. অমল বডুয়া, বৈদ্যপাড়ার সুকুমার বডুয়া চৌধুরী বাবুল, সারোয়াতলীর বিন্দু বডুয়া, রাউজান পাহাড়তলীর জগদানন্দ বডুয়া ও জীবনানন্দ বডুয়া, সুবর্ণ ভদ্র মুৎসুদ্দি, রনজিত বডুয়া। রাঙ্গুনিয়া থানায় বি এল এফ গ্রæপ কমান্ডার সালেহ আহমদ এর অধীনে সদস্য সুজন বডুয়া; এফ এফ গ্রুপ কমান্ডার খোদাবক্স- প্লাটুন কমান্ডার পদুয়ার অমিয় বডুয়া, সদস্য মরিয়ম নগরের রাজু বডুয়া ও সুধন বডুয়া, পারুয়ার কেপু বডুয়া, পদুয়ার স্বপন বডুয়া এবং সুদত্ত বডুয়া।
পটিয়া থানার ১৯৭০ সালে এমপি ও সংগঠক সুলতান আহমদ কুসুমপুরীর উদ্যোগে গঠিত বাহিনীতে ছিলেন ‘এ’ কোম্পানী, প্লাটুন কমান্ডার হাবিলদার আবুল হোসেন সদস্য সাতকানিয়ার সাধন বডুয়া; ‘বি’ কোম্পানী, প্লাটুন কমান্ডার হাবিলদার সুজায়েত হোসেন সদস্য পরেশ বডুয়া, এফ এফ গ্রুপ লিডার আবদুল লতিফ হাবিলদার, সদস্য অমিয় বডুয়া, অনিল বডুয়া, মিলন বডুয়া, দুলাল বডুয়া, রাজমোহন বডুয়া; এফ এফ গ্রুপ কমান্ডার শাহ আলম, সদস্য সুজিত বডুয়া, সুরক্ষিত বডুয়া, প্রিয়তোষ বডুয়া; এফ এফ গ্রুপ কমান্ডার আবু ছৈয়দ, সদস্য সুনক্ত বডুয়া; এফ এফ গ্রুপ কমান্ডার সিরু বাঙ্গালী, সদস্য হুলাইন এর মানবেন্দ্র বডুয়া মানু, ঠেগরপুনির তাপস রঞ্জন বডুয়া। সাতকানিয়া থানার এফ এফ গ্রুপ কমান্ডার আবু তাহের খান খসরু সদস্য সাতকানিয়ার জামিজুরির অনিল বডুয়া ও সাধন বডুয়া, মানিক বডুয়া, মৃণাল বডুয়া; এফ এফ গ্রæপ কমান্ডার আ ক ম শাসুজ্জামান সদস্য সাতকানিয়ার মুক্তিমান বডুয়া, মনোজ বডুয়া, রতন কুমার বডুয়া প্রমুখ।
ফটিকছড়ির এফ এফ গ্রুপ কমান্ডার মো. নুরুল গণির অধীনে সদস্য চাঁন্দু বডুয়া; এফ এফ গ্রুপ কমান্ডার শেখ আবু আহমদ এর অধীনে সদস্য নানুপরের বাবুল বডুয়া, পাইন্দং এর সুনীল বডুয়া; এফ এফ গ্রুপ কমান্ডার তপন দত্ত এর অধীনে নেপাল বডুয়া, নাথুরাম বডুয়া, নরেশ বডুয়া, প্রকাশ বডুয়া, এফ এফ গ্রুপ কমান্ডার ভারত বডুয়া প্রমুখ। এছাড়াও সিতাকুন্ড পান্থশালার মানিক লাল বডুয়া, কুমিল্লা নোয়াখালির সোনাইমুড়ির ডিআইজি এস কে চৌধুরী, কক্সবাজারের উখিয়ার সুরক্ষিত বডুয়া, অরবিন্দ বড়ুয়া, অমিয় কুমার বডুয়া, রামুর মাস্টার জ্ঞানেন্দ্র বডুয়া, দীপক কুমার বডুয়া, পরেশ বডুয়া, চকরিয়ার পরিমল বডুয়া, লোকনাথ বডুয়া, সাংবাদিক প্রিয়দর্শী বডুয়া প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধাদের নাম অগ্রগণ্য। বলা প্রয়োজন তাছাড়া আরও অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছে যারা ভারতের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। গ্রাম ও অঞ্চলভিত্তিক মুক্তিযোদ্ধাদের নাম সংগ্রহ করে প্রকাশ করা এবং তাঁদের অবদানের স্বীকৃতি দেওয়া উচিত।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বহু বৌদ্ধ চাকুরিজীবী নিখোঁজ বৌদ্ধদের একটি তালিকা মহাসংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথের তদানিন্তন সামরিক কর্মকর্তাদের কাছে পেশ করেছিলেন এবং তাদের উদ্ধারের জন্য আবেদন জানিয়ে প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের আর উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তাদের সংখ্যা ৪০ এর কাছাকাছি হবে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন রাউজানের সুপতি রঞ্জন বডুয়া এম.এ (অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পাকিস্তান রেলওয়ে), চিত্তরঞ্জন বডুয়া (স্টোনো রেলওয়ে জামুয়াইন), ননী গোপাল বডুয়া এম.এ (আয়কর উকিল, লাখেরা), প্রকৌশলী প্রভাষ কুসুম বডুয়া এম.এ (লাখেরা), ইছামতি রাঙ্গুনিয়ার চিত্তরঞ্জন বডুয়া (সুপার টি এন্ড টি, জোয়ারা) সে সময় টি এন্ড টিতে যে সমস্ত বৌদ্ধ চাকুরি করতেন তারা অনেকেই নিখোঁজ হয়। তাছাড়া বন্দরেরও অনেক বৌদ্ধ চাকুরিজীবী নিখোঁজ হয়।
ড. জগন্নাথ বডুয়া
সহকারী অধ্যাপক, পালি বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর, বাংলাদেশ।
(মূল প্রবন্ধের অংশ বিশেষ)
আমাদের কমেন্ট করার জন্য ধন্যবাদ। আমরা আপনার কমেন্ট পড়া মাত্র প্রতিক্রিয়া জানাতে চেষ্টা করবো।