মহাতীর্থ স্থান বুদ্ধগয়া - Moha Tirthastan Buddha Goya
'বুদ্ধগয়া’ হচ্ছে চার মহাতীর্থের একটি শ্রেষ্ঠ ‘তীর্থ। এটি অন্যতম মহাতীর্থ। যার প্রাচীন নাম ছিল উরুবেলা বা উরুবি। সিদ্ধার্থ গৌতম এখানে বেfধিবৃক্ষের নিচে বসে সাধনার মাধ্যমে শুভ বৈশাখী পূর্ণিমাতে বুদ্ধত্ব লাভ করেছিলেন। তখন থেকে তিনি বুদ্ধ বা গৌতমবুদ্ধ নামে পরিচিত। তাই বুদ্ধগয়া জগতের বৌদ্ধদের জন্য সবচেয়ে পবিত্র ও পুণ্যময় স্থান।
বুদ্ধগয়া
ভারতের বিহার রাজ্যে অবস্থিত। গয়া রেলস্টেশন থেকে ১১ কি.মি. দক্ষিণ-পশ্চিমে। স্টেশন
থেকে যে রাস্তাটি গিয়েছে সেটি প্রাচীন নৈরঞ্জনা নদীর কূল বেয়ে গেছে এবং সে নদীর বর্তমান
নাম ফল্গু নদী। বুদ্ধগয়ার প্রধান আকর্ষণ হলো বিশাল সুউচ্চ চারকোণা বুদ্ধমন্দির এবং
মন্দিরের গা ঘেঁষে বোধিবৃক্ষ ও বুদ্ধের বজ্ৰাসন। এ বোধিবৃক্ষ এক ঐতিহাসিক বৃক্ষ।
কারণ এ বোধিবৃক্ষের নিচে বসে সিদ্ধার্থ মারকে পরাজিত করে বোধিজ্ঞান লাভ করেন।
এ
বৃক্ষমূলে যে বজ্ৰাসন আছে সে আসনে বসেই সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধত্ব লাভ করেন। সপ্তম শতকে
হিউয়েন সাং ভারত পরিভ্রমণ করতে এসে বোধিবৃক্ষ ও বজ্ৰাসন দেখতে পান। এ বজ্ৰাসন একটি
অখণ্ড পাথরে নির্মিত বলে বর্ণিত। আর এ বোধিবৃক্ষের ছত্রছায়ায় সিদ্ধার্থ গৌতম পরমার্থ
জ্ঞান বা সর্বজ্ঞতা লাভ করেছিলেন বলে প্রত্যেক বৌদ্ধরা এ উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধাভরে বন্দনা
জানায়।
বৌদ্ধধর্মের
ইতিহাসে যে সমস্ত স্মৃতিসৌধ আছে তার মধ্যে বুদ্ধগয়ার এ মহাবোধি মন্দিরটি সবচেয়ে
প্রাচীন। সম্রাট অশোকই সর্বপ্রথম এটা বড় করে নির্মাণ করেছিলেন। বিশ্বের ইতিহাসে বুদ্ধগয়ার
এ মহাবোধি মন্দির এক বিশেষ উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে আছে। কারণ, সিংহল, মায়ানমার,
শ্যাম, তিব্বত, নেপাল ও কম্বোডিয়ায় এই মন্দিরের অনুকরণে অনেক মন্দির নির্মিত হয়েছে।
বুদ্ধগয়র
চারপাশে ছোট বড় বহু স্থূপ, স্তম্ভ, স্মৃতিসৌধ, উঁচু তোরণ, বুদ্ধের পদচিহ্ন মন্দিরের
শোভা বৃদ্ধি করেছে। বোধিবৃক্ষের পশ্চিম-উত্তর পাশে বুদ্ধের পদচিহ্ন আঁকা পাথর আছে।
মন্দিরের চারদিকে পাথরের প্রাচীর আছে। বুদ্ধগয়ার মূল মন্দিরে আছে উপবিষ্ট বড় বুদ্ধমূর্তি।
মূর্তির পরিধানের চীবর সুক্ষ্ম রেখা দ্বারা দেখানো হয়েছে।
মূর্তিটি
১.৬৫ মিটার উপরে স্থাপিত। মূর্তিটির উচ্চতা ৫ ফুট ৫ ইঞ্চি এবং প্রস্থ ২ ফুট ৪ ইঞ্চি,
৬ ফুট ৬ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য এবং ৪ ফুট ৬ ইঞ্চি উচ্চতা। মন্দিরটি দ্বিতল বিশিষ্ট। মন্দিরের
চার কোনায় চারটি ক্ষুদ্র মন্দির মূল মন্দিরের শোভা বর্ধন করছে।
সম্মুখের
দুই কোনায় দুটিতে উপরে উঠার সিঁড়ি আছে। সিঁড়িতে দু'টি বোধিসত্ত্ব পদ্মপানির মূর্তি
এবং মূল মন্দিরের ভিতরে দণ্ডায়মান অবলোকিতেশ্বরের একটি মূর্তি আছে। মূর্তি দু'টি
যেমন সুন্দর তেমন চিত্তাকর্ষক। এর শিরোভাগের দু’পাশে দুটি ধর্মচক্র মূর্তি, মাঝখানে দু'দিকে দু'টি অভয়মুদ্রায়
স্থিত বুদ্ধমূর্তি এবং পদপ্রান্তের দু'পাশে দুটি দেবমূর্তি অঙ্কিত আছে।
মন্দিরের
চারদিকে পাথরের প্রাচীর আছে। আগে এই প্রাচীরের ১২৪ টি স্তম্ভ ছিল। তার মধ্যে এখন মোট
৯০টি স্তম্ভ পাওয়া যায়। প্রাচীরের গায়ে গৌতম বুদ্ধের জীবনের বহু ঘটনা ও জাতকের কাহিনী
অঙ্কিত আছে। বুদ্ধগয়ার মন্দিরের অদূরে মুচলিন্দ হ্রদ আছে। সেখানে নাগরাজ মুচলিন্দ
থাকতেন এবং বুদ্ধকে তিনি ঝড়-ঝঞা থেকে সাত দিন রক্ষা করেছিলেন।
বুদ্ধগয়ার
মূল মন্দিরে ঢোকার সময় বাঁদিকে নিচু পাঁচটি কক্ষ আছে। কক্ষগুলোতে পাঁচটি একই রকম
বুদ্ধমূর্তি আছে।
বুদ্ধগয়ার
মূল মন্দিরের আশে পাশে আরো অন্যান্য প্রসিদ্ধ স্থান রয়েছে। সে প্রসিদ্ধ স্থানগুলো
হচ্ছে-অনিমেষ চৈত্য, মুচলিন্দ হ্রদ, রাজায়তন বৃক্ষ, চংক্রমণ কুটী, রতনঘর ও অজপাল ন্যগ্রোধ।
অনিমেষচৈত্য মূলমন্দিরের উত্তরপূর্ব কোণে একটি অনুচ্চ টিলার উপর মূলমন্দিরের নির্মিত
ছোট মন্দির। বোধিলাভের দ্বিতীয় সপ্তাহ বুদ্ধ এ স্থানেই অতিবাহিত করেন।
মূলমন্দিরের
উত্তর পাশে ৩ ফুট উচু এবং ৬ ফুট দীর্ঘ চত্বও যুক্ত একটি স্থান আছে। তার পাশেই নিচের
সমতল ভূমিতে ১৯ পদ্মচিহ্নিত অঙ্কিত স্থম্ভ আছে। এগুলো একেকটি পদচিহ্নের প্রতীক। কথিত
আছে বোধিলাভের পর বুদ্ধ এ স্থানেই তৃতীয় চংক্রমন বা পদচারণা করেন। তাই এটি চংক্রমণ
কুটি নামে পরিচিত। মূলমন্দিরের উত্তর-পশ্চিমকোণে অর্ধভঙ্গ একটি মন্দির আছে।
বোধিলাভের
ও চতুর্থ সপ্তাহটি এ স্থানে কার্যকারণনীতি ব্যাখ্যা করে অতিবাহিত করেন। তাই রত্নঘর
নামেই অভিহিত। মূলমন্দিরের প্রবেশ পথেই অজপাল বৃক্ষের স্থানটি অবস্থিত। বোধিলাভের
পর বুদ্ধ পঞ্চম সপ্তাহ এ স্থানেই অতিবাহিত করেন। মূলমন্দিরের দক্ষিণে একটি হ্রদ বা
পুষ্করিণী রয়েছে। বােধিজ্ঞান লাভের পর বুদ্ধ ষষ্ঠ সপ্তাহটি এস্থানে বসেই অতিবাহিত
করেন।
বোধিদ্রুমসহ
এগুলোকে সপ্ত মহাস্থান বলে। শ্রদ্ধাবান বৌদ্ধরা এই সপ্ত মহাস্থানের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা
ও
বন্দনা নিবেদন করেন এ ভাবে-
পঠমং
বোধি পালঙ্কং, দুতিযং অনিমিসম্পি চ,
ততিযং
চঙ্কমণ সেটঠং, চতুথং রতনঘরং।
পঞ্চমং
অজপালঞ্চ, মুচলিন্দঞ্চ ছটমং,
সত্তমং
রাজাযতনং, বন্দেতং বোধিপাদপং।
প্রথম
বোধিপালঙ্ক, দ্বিতীয় অনিমেষ চৈত্য, তৃতীয় চংক্রমণ চৈত্য, চতুর্থ রতনঘর চৈত্য, পঞ্চম
অজপাল ন্যগ্রোধ বৃক্ষ, ষষ্ঠ মুচলিন্দ মূল, সপ্তম রাজায়তন বৃক্ষ-এই সপ্ত মহাস্থানকে
আমি অবনত শিরে বন্দনা জানাচ্ছি।
সম্রাট
অশোকের কন্যা ভিক্ষুণী সংঘমিত্রা এ বোধিবৃক্ষের দক্ষিণ শাখা নিয়ে গিয়ে সিংহলের
অনুরাধাপুরে রোপন করেছিলেন। সাঁচীর মূল স্কুপের পূর্ব তােরণে এ দৃশ্যটি খুব সুন্দরভাবে
অঙ্কিত আছে। বুদ্ধের সময়েও আনন্দ স্থবির এর একটি শাখা নিয়ে শ্রাবস্তীর জেতবন বিহারে
রােপন করেছিলেন। শ্রাবস্তীর ঐ বোধিবৃক্ষটি এখনো আনন্দবোধি নামে পরিচিত।
সম্রাট
অশোকের শিলালিপি থেকে জানা যায়, তিনি মন্ত্রীগণসহ তাঁর রাজত্বের দশম বর্ষে এখানে
এসেছিলেন। সপ্তম শতাব্দীতে হিউয়েন সাং ভারতবর্ষের বুদ্ধগয়ায় এসেছিলেন। তিনি তখন
বজ্ৰাসনটি বোধিবৃক্ষের নিচে দেখতে পান।
মহাবোধি
বিহারের অদূরে একটি জাদুঘর আছে। সেখানে বুদ্ধগয়ায় প্রাপ্ত প্রত্নবস্তুগুলো সংরক্ষিত
রয়েছে। পৃথিবীর সকল বৌদ্ধদের জন্য এটি একটি পণ্যময় মহাতীর্থস্থান।
আমাদের কমেন্ট করার জন্য ধন্যবাদ। আমরা আপনার কমেন্ট পড়া মাত্র প্রতিক্রিয়া জানাতে চেষ্টা করবো।