এ(caps)ক দিন রাজা মিলিন্দ পরিত্রাণ পাঠ বিষয়ে
একটি প্রশ্ন উত্তাপন করেন। তার মতে বুদ্ধ এক দিকে বলেছেন সকল জীব মরণশীল, জীব মাত্রই
একদিন মরবে। অপর দিকে বুদ্ধ পরিত্রাণ সূত্রও পাঠ করেছেন। যদি সকলেই মরবেনই তাহলে এই
পরিত্রাণের কাজ কি? চলুন জেনে আসি ভান্তে নাগসেন কিভাবে এর উত্তর দিয়েছেন।
“ভন্তে নাগসেন! ভগবান ইহাও বলিয়াছেন‘উপরে আকাশে নহে, নীচে সমুদ্র-মধ্যেও নহে
পর্বতরাজির বিবরে প্রবেশ করিয়াও নহে, জগতে এমন গুপ্তস্থান কোথাও বিদ্যমান নাই, যেখানে
থাকিয়া মৃত্যুপাশ হইতে মুক্ত হওয়া যায়’।
আবার ভগবান পরিত্রাণ সমূহেরও উপদেশ করিয়াছেন।
যথা, রতনসূত্র, মৈত্রীসূত্র, খন্ধ পরিত্রাণ, ময়ূর পরিত্রাণ, ধ্বজাগ্র পরিত্রাণ, আটানাটিয়
পরিত্রাণ, অঙ্গুলিমাল পরিত্রাণ।
ভন্তে! যদি আকাশে উঠিয়া, সমুদ্র মধ্যে
গিয়া অথবা প্রাসাদ-কুটি, কন্দর, গুহা, গহ্বর, খাদ, বলি গিরি-বিবর, পর্বতাভ্যন্তরে প্রবেশ
করিয়াও মৃত্যু-পাশ হইতে মুক্ত হয় না, তাহা হইলে পরিত্রাণ কর্ম মিথ্যা। আর যদি পরিত্রাণ
অনুষ্ঠান দ্বারা মৃত্যু-পাশ হইতে মুক্ত হওয়া যায় তাহা হইলে-‘উপরে আকাশে নহে-----’ এই
বাক্য মিথ্যা প্রমাণিত হয়। ইহাও গ্রন্থিল হইতে গ্রন্থিলতর উভয় কোটিক প্রশ্ন, আপনার
সমীপে উপস্থাপিত হইয়াছে। আপনাকে ইহার সমাধান করিতে হইবে।”
(ads1)
“মহারাজ! ভগবান ইহাও বলিয়াছেন- উপরে আকাশে
নহে----’ এবং ভগবান পরিত্রাণ সমূহও উপদেশ করিয়াছেন। কিন্তু তাহা কেবল তাহার জন্য যাহার
আয়ু অবশিষ্ট আছে, যিনি বয়স সম্পন্ন এবং যাহার (উপচ্ছেদ) কর্মারবণ অপগত হইয়াছে।
মহারাজ! যাহার আয়ু শেষ হইয়াছে তাহার স্থিতির
জন্য কোন ক্রিয়া বা উপক্রম নাই। মহারাজ! যেমন কোন শুষ্ক, নিঃসার, নীরস, জীবনীশক্তিহীন,
বিগত বা পল্লবিত সবুজবর্ণ আর ফিরিয়া আসেনা, সেইরূপ, মহারাজ! যাহার আয়ু শেষ হইয়াছে,
তাহার স্থিতির নিমিত্ত ভৈষজ্য পরিকর্মদ্বারা কোন প্রক্রিয়া বা উপক্রমের ফল নাই।
মহারাজ! সংসারে যে সকল ঔষধ ও ভৈষজ্য আবিষ্কার
হইয়াছে, উহারা ক্ষীণয়ুব্যক্তির কোন কাজে আসে না। যাহার আয়ু অবশিষ্ট আছে, যিনি বয়ঃসম্পন্ন
এবং যাহার কর্মাবরণ অপগত হইয়াছে তাহাকেই পরিত্রাণ রক্ষা করে, ত্রাণ করে। তাহার জন্যই
ভগবান পরিত্রাণ অনুষ্ঠানের উপদেশ করিয়াছেন।
মহারাজ! যেমন ধান্য পরিপক্ক হইয়া শস্য
নাল মৃত হইলে কৃষক ক্ষেত্রে জল প্রবেশ বন্ধ করে, কিন্তু যখন শস্য তরুণ, মেঘসন্নিভ সবুজ,
বয়ঃসম্পন্ন থাকে তখন বারবার জলসিঞ্চন করে, সেইরূপ মহারাজ! যাহার আয়ু শেষ হইয়াছে তাহার
ঔষধ ও পরিত্রাণ ক্রিয়া নিবারিত ও পরিত্যক্ত হইয়াছে। কিন্তু যে সকল লোকের আয়ু অবশিষ্ট
আছে, যথেষ্ট বয়স আছে, তাহাদের জন্য পরিত্রাণ ও ভৈষজ্যগুলি উপদিষ্ট হইয়াছে, এবং তাহারা
পরিত্রাণ ও ভৈষজ্যসমূহ দ্বারা নিশ্চয় উপকৃত হয়।”
“ভন্তে! যদি ক্ষীণায়ুব্যক্তি মরে আর অবশেষায়ু
ব্যক্তি জীবিত থাকে, তাহা হইলে পরিত্রাণ ও ভৈষজ্য সমূহ নিরর্থক নহে কি?”
“মহারাজ! কেমন আপনি পূর্বে কখনও দেখিয়াছেন কি ভৈষজ্যদ্বারা
কোন রোগ নিবারিত হইয়াছে?”
“হাঁ, ভন্তে! অনেক শত দেখিয়াছি।”
“মহারাজ! তাহা হইলে আপনার কথিত‘পরিত্রাণ ও ভৈষজ্য ক্রিয়া নিরর্থক’ এই বাণী মিথ্যা হয়।”
“ভন্তে! চিকিৎসকগণের প্রচেষ্টা, ঔষধ পান ও অনুলেপন দেখা যায়,
এবং তাহাদের সেই প্রচেষ্টা দ্বারা রোগ নিরাময় হয়।”
“মহারাজ! পরিত্রাণেও আবৃত্তিকারীদের শব্দ শোনা যায়, জিহ্বা
শুষ্ক হয়, হৃদয় চঞ্চল হয়, এবং কণ্ঠ অভিভূত হয়। সুতরাং উহাদের প্রবর্তন প্রভাবে সর্ববিধ
ব্যাধি উপশম হয়, এবং সমস্ত উপদ্রব বিদ্রুরিত হয়।
মহারাজ! আপনি এমন কোন সর্পদষ্ট ব্যক্তিকে
দেখিয়াছেন মন্ত্র প্রভাবে যাহার বিষ নামাইবার সময় উপরে, নীচে জল সিঞ্চন করিতে থাকে?”
“হাঁ, ভন্তে! আজও জগতে তাহা বর্তমান আছে।”
“মহারাজ! তাহা হইলে পরিত্রাণ ও ভৈষজ্য প্রক্রিয়া সমূহ নিরর্থক
এই কথা মিথ্যা প্রমাণিত হয়। মহারাজ! পরিত্রাণকৃত ব্যক্তিকে সর্প দংশন করিতে ইচ্ছা করিয়াও
দংশন করে না, তাহার খোলা মুখ বন্ধ করে; চোরদিগের উৎক্ষিপ্ত দণ্ড তাহার উপর পতিত হয়
না, তাহারা দণ্ড ত্যাগ করিয়া তাহার প্রজ্বলিত মহান্ অগ্নিরাশিও তাঁহার সমীপে আসিয়া
নির্বাপিত হয়; তিনি হলাহল বিষপান রিলেও তাহা ঔষধ হয় বা পুষ্টিকর খাদ্যে পরিণত হয়; বধেচ্ছু
হত্যাকারীরা সমীপে আসিয়া অনুগত সেবকে পরিণত হয়, এবং পাশ-গৃহীত হইলেও তাহাতে আবদ্ধ হয়
না।”
“মহারাজ! আপনি পূর্বে শুনিয়াছেন কি পরিত্রাণ-কৃত ময়ূরকে সাতশত
বর্ষ ব্যাপী চেষ্টা করিয়া ব্যাধ তাহাকে পাশবদ্ধ করিতে পারে নাই; কিন্তু যেই দিন পরিত্রাণ
পাঠ করে নাই সেই দিনই তাহাকে পাশবদ্ধ করিয়াছিল?”
“হাঁ, ভন্তে! শোনা যায়, ইহার খ্যাতি দেবলোকসহ সমস্ত জগতে প্রসিদ্ধ
আছে।”
“তাহা হইলে, মহারাজ! ‘পরিত্রাণ ভৈষজ্য প্রক্রিয়া নিরর্থক’ এই যে বলিলেন, তাহা মিথ্যা।”
“মহারাজ! আপনি কখনও শুনিয়াছেন কি কোন দানব স্বীয় স্ত্রীকে
ব্যভিচার হইতে রক্ষার মানসে কৌটার মধ্যে নিক্ষেপ করিয়া গিলিয়া ফেলিয়া উদরে বহন করিতে
থাকে। অনন্তর এক বিদ্যাধর সেই দানবের মুখ দিয়া প্রবেশ করিয়া তাহার স্ত্রীর সহিত অভিরমিত
হয়। যখন দানব জানিতে পারিল তখন কোটা খোলা মাত্রই বিদ্যাধরের যথেষ্ট পলায়ন করিল?”
(ads1)
“মহারাজ! সেই বিদ্যাধর পরিত্রাণ বা মন্ত্র বলে দানবের হাত
হইতে মুক্ত হইয়া যখন ধরা পড়ে তখন মন্ত্রবলে অদৃশ্য হইয়া গিয়াছিল?”
“হাঁ, ভন্তে! শোনা যায়। এই কথা দেবলোকসহ পৃথিবীতে প্রসিদ্ধ
আছে।”
“মহারাজ! সেই বিদ্যাধর পরিত্রাণ বা মন্ত্র বলে দানবের হাত
হইতে মুক্ত হইয়াছিল নহে কি?”
“হাঁ, ভন্তে!”
“মহারাজ! তাহা হইলে অবশ্যই পরিত্রাণের বল আছে!”
ভন্তে নাগসেন! পরিত্রাণ কি সকলকেই রক্ষা
করে?”
“মহারাজ! পরিত্রাণ কাউকে রক্ষা করে, আর কাউকে রক্ষা করে না।”
“ভন্তে! তাহা হইলে পরিত্রাণ সকলের অর্থ-সাধক নহে!”
“মহারাজ! কেমন, ভোজন সকলের জীবন রক্ষা করে কি?”
“ভন্তে! কাহারও রক্ষা করে আর কাহারও রক্ষা করে না।”
“কি কারণে?”
“ভন্তে! যেহেতু কেহ কেহ সেই ভোজন অধিক মাত্রায় খাইয়া বিসূচিকায়
মারা যায়।”
“মহারাজ! তাহা হইলে ভোজন জীবন হরণ করে। অতিভোজন ও পাচক অগ্নির
দৌর্বল্যের দরুণ।
ভন্তে! আয়ুপ্রদ ভোজনও অপব্যহারে জীবন
হানিকর হয়।”
“মহারাজ! তিন কারণে পরিত্রাণ রক্ষা-কার্যে সফল হয় না-
(১) কর্মাবরণের দরুণ, (২) ক্লেশাবরণের
দরুণ, এবং (৩) শ্রদ্ধা বা বিশ্বাসহীনতার দরুণ।
মহারাজ! পরিত্রাণ সত্ত্বগণের অনুরক্ষক।
তাহাদের স্বীয় স্বার্থের দরুণ আরক্ষা ব্যাহত হয়।
মহারাজ! যেমন মাতা গর্ভস্থিত সন্তানকে
পোষণ করে, হিতজনক উপচারে তাহাকে প্রসব করে, প্রসবের পর অশুচি, মল, শিক্নি অপসারণ পূর্বক
উত্তম ও শ্রেষ্ঠতম সুগন্ধি লেপন করে। অপর সময়ে সেই বালক পরের ছেলেদের দ্বারা আক্রান্ত
ও প্রহৃত হইয়া তাহাদিগকে আঘাত করে। তাহারা ক্রুদ্ধ হইয়া তাহাকে সভাতে টানিয়া আনে এবং
ধরিয়া নিয়া বিচারকের সমীপে উপস্থিত করে। বিচারে তাহার পুত্র যদি সীমা ল ঘন করে ও অপরাধী
সাব্যস্ত হয়, তবে বিচারকের মানুষেরা তাহাকে সজোরে আকর্ষণ করে এবং দ-, মুদ্গর জানু ও
মুষ্টি দ্বারা প্রহার করে, আঘাত করে। মহারাজ! তখন কি তাহার মাতা আকর্ষণ, পরিকর্ষণ,
গ্রহণ ও প্রভুর সমীপে নয়ন রোধ করিবার সুযোগ লাভ করে?”
“না, ভন্তে!”
“মহারাজ! কি কারণে?”
“ভন্তে! তাহার নিজের অপরাধের দরুণ।”
“মহারাজ! এইরূপে প্রাণিগণের আরক্ষা ও পরিত্রাণ নিজের অপরাধের
দরুণ বন্ধ্যা হয়।”
“সাধু, ভন্তে! প্রশ্ন উত্তম রূপে মীমাংসিত হইয়াছে। আপনি গভীরকে
অগভীর করিয়াছেন। অন্ধকারকে আলোকোজ্জ্বল করিয়াছেন, ভ্রান্তি জাল নিরসন করিয়াছেন; আপনি
সত্যই গণিবর-প্রবরদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম।”
আমাদের কমেন্ট করার জন্য ধন্যবাদ। আমরা আপনার কমেন্ট পড়া মাত্র প্রতিক্রিয়া জানাতে চেষ্টা করবো।