বৌদ্ধমতে শাশ্বত আত্মার অস্তিত্বে অস্বীকার করলে জন্মান্তরবাদ স্বীকার করা যায় কি?
জীবের
চেতন সত্তা ক্ষণস্থায়ী প্রবাহ বা ধারার ন্যায় পরিবর্তনশীল। প্রতিটি ক্ষণের অনুভূতি
একটি কার্য-কারণমালা বা শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকে বলেই আমাদের মনে একটি স্থায়ী আত্মার ভ্রান্ত
ধারণার সৃষ্টি হয়।
‘সংযুক্ত নিকায়ে’ বলা হয়েছে, বিনাশশীল দেহে অবিনাশী আত্মা
হতে পারে না। আবার ইন্দ্রিয়ানুভূতি, প্রবৃত্তি, বুদ্ধি প্রভৃতির সাহায্যেও অবিনাশী
আত্মা গঠিত হতে পারে না, কারণ এগুলি বিনাশশীল। বিনাশশীল উপাদান দিয়ে গঠিত আত্মা অবিনাশী
হতে পারে না। ‘মজ্ঝিমনিকায়ে’ বলা হয়েছে, স্থায়ী আত্মার
ধারণা অজ্ঞান-প্রসূত ও পরিত্যাজ্য।
নিত্যতাবাদীদের আত্মা সম্বন্ধীয় সিদ্ধান্তকে বুদ্ধ দুইভাগে ভাগ করেছেন- রূপ বিশিষ্ট (ইন্দ্রিয়গোচর) এবং অরূপ। এই দুই মতবাদী দার্শনিকদের কেউ আবার আত্মাকে অনন্ত বলে মানেন, কেউ সান্ত (অনু সদৃশ)। ফলে মহানিদানসূত্ত অনুযায়ী এদেরকেও নিত্যবাদী এবং অনিত্যবাদী এই দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
(দীঘনিকায়:
২/১৫)।
তবে
আত্মাবাদের ব্যাখ্যার জন্য বুদ্ধ ‘সৎকায়-দৃষ্টি’ নামে একটি নতুন শব্দ ব্যবহার করেছেন। উল্লেখ্য, বুদ্ধের
বোধিবিদ্যা ব্যক্ত করার জন্য সে যুগের প্রচলিত ভাষা তখনো যোগ্য হয়ে ওঠেনি বলে ধারণা
করা হয়। তাই নিজের সিদ্ধান্তকে প্রকট করার জন্য তিনি ধর্ম, বস্তু, বিজ্ঞান কিছু প্রাচীন
শব্দকে যেমন নব্য অর্থে প্রয়োগ করেছিলেন, তেমনি প্রতীত্য-সমুৎপাদ, সৎকায় প্রভৃতির ন্যায়
কিছু নতুন শব্দও সৃষ্টি করেছিলেন। সৎকায় অর্থ কায়ায় বিদ্যমান, অর্থাৎ কায়া হতে অজর
অমর সত্তা।
সৎকায়ের
(আত্মা) ধারণাকে বুদ্ধ দর্শনের ক্ষেত্রে এক কঠিন বাধা বলে মনে করতেন এবং সত্য জ্ঞান
লাভের জন্য তা দূর হওয়া সর্বাধিক প্রয়োজনীয় মনে করতেন। বুদ্ধের শিষ্যা পণ্ডিতা ধম্মদিন্না
তাঁর এক উপদেশে বলেছেন- ‘পঞ্চ উপাদান-স্কন্ধ ই সৎকায়। এবং সৎকায়-দৃষ্টির কারণ হলো গমনাগমনের
তৃষ্ণা।’
(চূলবেদল্লসূত্ত,
মজ্ঝিমনিকায়:১/৫/৪)।
এই গমনাগমন হলো পুদ্গল বা আত্মার এক দেহ থেকে অন্য দেহে স্থানান্তরের অবিদ্যাপ্রসূত সংস্কার-ধারণা।
প্রতীত্য-সমুৎপাদ তত্ত্ব-সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বুদ্ধ অবিদ্যা এবং তৃষ্ণা থেকে মানুষের সমুদয় প্রবৃত্তির ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি সৎকায়-দৃষ্টি বা আত্মাবাদের ধারণাকে নৈসর্গিক বলে মানেননি, তাই বলেছেন- ‘নবজাত দুগ্ধপোষ্য শিশুর সৎকায় সম্বন্ধে কোন ধারণা থাকে না, সৎকায়-দৃষ্টি তার কোথা থেকে আসবে?’
(মহামালুঙ্ক্যসূত্ত, মজ্ঝিমনিকায়: ২/২/৪)
একটি
জীবন থেকে অন্য কোন জীবনে আত্মার প্রবেশ কল্পনা করা সম্ভব নয়, কেবল ঘটনা পরম্পরায় নতুন
জীবনের উদ্ভব ঘটে। কোন এক মুহূর্তে আমাদের মধ্যে যেসব মানসিক প্রক্রিয়াগুলি দেখা যায়,
সেই মানসিক প্রক্রিয়াগুলির ধারা বা প্রবাহই (stream of consciousness) হলো আত্মা। চিন্তা,
ইচ্ছা, সুখ-দুঃখ প্রভৃতির প্রত্যেকটি ক্ষণকালের জন্য স্থায়ী। এই প্রবাহের অন্তরালে
কোন শাশ্বত বা চিরন্তন সত্তার অস্তিত্ব নেই। এই মতবাদই নৈরাত্ম্যবাদ বা অনাত্মবাদ নামে
পরিচিত।
বুদ্ধ অনাত্মা বলতে আত্মার বিপরীতে কোন অভাবাত্ম বস্তু বোঝাতে চাননি। বৈদিক উপনিষদে আত্মাকেই নিত্য ধ্রুব, বস্তু-সত্য বলে মানা হয়েছে। তাই আত্মার অর্থ যদি নিত্য হয়, তাহলে অনাত্মা মানে অ-নিত্য। তাই তিনি বলেছেন- ‘রূপ অনাত্মা, বেদনা অনাত্মা, সংজ্ঞা …সংস্কার …বিজ্ঞান …সমগ্র ধর্মই অনাত্মা।’
(চূলসচ্চকসূত্ত, মজ্ঝিমনিকায়-১/৪/৫)
অনাত্মবাদ
মতে স্থায়ী আত্মায় বিশ্বাস করা এক প্রকার ভ্রম। বুদ্ধ শাশ্বত আত্মাকে নিষেধ করে বলেছেন,
বিশ্বে না কোন আত্মা বা আত্মার মতো অন্য কোন বস্তু আছে।
পঞ্চ
জ্ঞানেন্দ্রিয়ের আধারস্বরূপ হচ্ছে মন বা মনের বেদনা। এদের অতিরিক্ত আত্মা বা আত্মাসদৃশ
কোন বস্তু নেই। বুদ্ধমতে জগতের সমস্ত বস্তু অনিত্য। তিনি অনুগামী শিষ্যদের বারবার উপদেশ
দিয়েছেন যেন তাঁরা নিত্য আত্মার ধারণা পরিত্যাগ করেন।
আত্মভ্রমে
পীড়িত ব্যক্তি প্রকৃত আত্মস্বরূপ জানতে পারে না, তথাপি সে আত্মায় অনুরক্ত হয়। একে তিনি
কোন অদৃষ্ট অজ্ঞাত পরম সুন্দরী নারীতে কারো অনুরাগের মতো হাস্যাস্পদ বলে উল্লেখ করেন।
নদীর
জলে যেমন বুদবুদ নিরন্তর পরিবর্তিত হতে থাকলেও তাতে একময়তা থাকে সেরূপ আত্মার বিজ্ঞানের
নিরন্তর পরিবর্তন হলেও তাতে একময়তা থাকে। সেকারণে প্রত্যভিজ্ঞান প্রভৃতির অনুপপত্তি
হয় না।
বৌদ্ধসাহিত্যে এই সংঘাতবাদের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করতে বহু উপাখ্যান প্রচলিত আছে। তবে বৌদ্ধধর্মের উপদেষ্টা দার্শনিক নাগসেন (১৫০ খ্রিষ্টপূর্ব) ভারতে রাজ্য পরিচালনাকারী গ্রীক রাজা ও বিদ্বান দার্শনিক মিলিন্দ (মিনান্দর)-এর সাথে দার্শনিক বিতর্কের মাধ্যমে বুদ্ধের দর্শনসূত্রের উদাহরণসহ যে ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন, এর মাধ্যমেই নৈরাত্ম্যবাদে আত্মার স্বরূপ তথা সংঘাতবাদের তাৎপর্য আকর্ষণীয়ভাবে বিশ্লেষণ করা হয়। (‘মিলিন্দ প্রশ্ন’: অনুবাদক ভিক্ষু জগদীশ কাশ্যপ।
সূত্র:
দর্শন-দিগদর্শন/ রাহুল সাংকৃত্যায়ন)।
একবার নাগসেন শিয়ালকোট নগরের অসংখ্যেয় নামক মঠে উপস্থিত হলে রাজা মিলিন্দের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। নাগসেন রাজাকে বৌদ্ধ নৈরাত্ম্যবাদ ব্যাখ্যা করেন। কিন্তু মিলিন্দ কিছুতেই নৈরাত্ম্যবাদের পূর্ণ তাৎপর্য গ্রহণ করতে পারছেন না দেখে নাগসেন রাজাকে প্রশ্ন করেন- আপনি পদব্রজে এসেছেন, না রথে? উত্তরে রাজা বলেন যে তিনি রথে চড়ে এসেছেন। তখন নাগসেন রাজাকে আবার প্রশ্ন করেন- রথটা কী? রথের চুড়ো বা চাকা বা রজ্জু বা অন্যান্য অংশ কি আলাদা আলাদাভাবে রথ? অথবা এর মিলিত রূপই কি রথ? কিংবা এর অতিরিক্ত কিছুকে কি রথ বলে? তখন রাজা বুঝতে পারেন যে রথের কোন একটি অংশ রথ পৃথকভাবে রথ নয়। রথ হলো সমস্ত অংশের সংঘাত বা সমাহার। তখন নাগসেন বলেন- একইভাবে আত্মা হলো কতকগুলি স্কন্ধের সংঘাত বা সমাহার। কেবল আত্মাই নয়, প্রত্যেক জড়বস্তুও কতকগুলি স্কন্ধের সংঘাত বা সমাহার। ‘অবয়বীক আধারে যেমন ‘রথ’-এর সংজ্ঞা নির্ণীত হয়, তেমনই (রূপাদি) স্কন্ধ থেকে এক সত্তাকে (জীবকে) বোঝা যায়।’
(সংযুক্তনিকায়: ৫/১০/৬)
এই
স্কন্ধ পাঁচ প্রকার- রূপ বা দেহ, বেদনা বা সুখ-দুঃখ প্রভৃতির অনুভূতি, সংজ্ঞা বা প্রত্যক্ষ,
সংস্কার তথা রাগ দ্বেষ প্রভৃতি পূর্ব অভিজ্ঞতাজাত প্রবণতা এবং বিজ্ঞান বা আলয় বিজ্ঞান
ও প্রবৃত্তি বিজ্ঞানের প্রবাহ। আত্মা নামক সংঘাতের নির্মাতা দৈহিক অবস্থাসমূহকে রূপ
বলা হয়। অপরপে বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞানস্কন্ধকে একত্রে বলা হয় মন বা নাম।
সুতরাং আত্মা দেহ-মন বা নামরূপের সংঘাত ছাড়া অন্য কিছু নয়।
জীবদেহের
কল্পিত পরিচালক বিশেষ কোন আত্মার অস্তিত্বহীনতা বোঝাতে গিয়ে নাগসেন আরো বলেন-
‘…যদি শরীর থেকে ভিন্ন কোন আত্মাই থাকে যে আমাদের দেহের মধ্যে থেকে উক্ত কর্মসমূহ (দর্শন, শ্রবণ, গন্ধানুভব, রসাস্বাদন, স্পর্শানুভব, জ্ঞাত করানো) সম্পাদন করে, তবে তো চক্ষু উৎপাটিত করলে এবং নাসিকা-কর্ণ-জিহ্বা ছেদন করলেও তার দেখতে, শুনতে, গন্ধ অনুভব এবং রসাস্বাদন করতে আরও সক্ষম হওয়া উচিত এবং সংহার করলেও স্পর্শানুভূতি থাকা যুক্তিসংগত। …এরকম কোন কথা নেই (ঘটে না)। …অতএব আমাদের দেহাভ্যন্তরে কোন আত্মার অস্তিত্বও নেই।’
(সংযুক্তনিকায়: ৩/৪/৪৪)
বুদ্ধ
বিশ্বের মূল উপাদানকে বিজ্ঞান (নাম) এবং বস্তু (রূপ) এই দুই ভাবে বিভক্ত করেছেন। যত
স্থূল বস্তু আছে সবই রূপ, এবং যত সূক্ষ্ম মানসিক বস্তু আছে সবই নাম। …উভয়েই পরস্পরাশ্রিত,
একটি ছাড়া অন্যটির অস্তিত্ব থাকে না। সর্বদা একত্রে অবস্থিত। সদাই…প্রবহমান।
যদিও
মানুষের মধ্যে কোন অপরিবর্তনীয় সত্ত্বার অস্তিত্ব নেই, তথাপি আমাদের জীবনের বিভিন্ন
অবস্থার মধ্যে একটা ধারাবাহিকতা আছে। প্রতি পূর্ববর্তী অবস্থা একদিকে অন্য অবস্থা থেকে
উদ্ভূত। আবার অন্যদিকে পরবর্তী অবস্থা সৃষ্টি করে চলেছে।
সুতরাং
জীবনের ধারাবাহিকতার মূলে একটা কার্যকারণ সম্বন্ধের যোগসূত্র আছে। বিষয়টিকে একটি আগুনের
শিখার দৃষ্টান্তের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকে।
সারারাত
ধরে একটা প্রদীপ জ্বলতে থাকলে যদিও প্রতিটি মুহূর্তে আমরা প্রদীপের একটিমাত্র শিখাই
দেখি, তবুও আসলে যে-কোন মুহূর্তের শিখাই অন্য মুহূর্তের শিখা থেকে আলাদা। কারণ প্রতি
মুহূর্তেই প্রদীপের সলতে বা প্রদীপের তেলের ভিন্ন ভিন্ন অংশই পুড়ছে। অনুরূপভাবে আমাদের
জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ভিন্ন হলেও সমস্ত জীবনের মধ্যে একটা ধারাবাহিকতা আছে।
‘এভাবেই
কোন বস্তুর অস্তিত্বের শিহরণের মধ্যে এক অবস্থা উৎপন্ন হয়, এক লয় হয়- এইভাবেই প্রবাহ
ক্রমান্বিত থেকে যায়। একটি প্রবাহের দুটি অবস্থার মধ্যে কখনও একটি মুহূর্তও স্তব্ধ
থাকে না, একের লয়প্রাপ্তির সঙ্গে আর একটির উদ্ভব হয়। এ কারণেই না তা আত্মা (জীব), না
অন্য কিছু। এক জীবনের অন্তিম বিজ্ঞানের (চেতনার) লয়প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে অন্য আর এক
জীবনের প্রথম বিজ্ঞানের সূচনা হয়।’
বৌদ্ধ
সম্প্রদায় জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী। জাতকের বহু গল্পে পুনর্জন্মের কাহিনী বিবৃত হয়েছে।
তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠে যে, বৌদ্ধমতে
শাশ্বত আত্মার অস্তিত্বে অস্বীকার করলে জন্মান্তরবাদ স্বীকার করা যায় কি?
এ
প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, নৈরাত্ম্যবাদী বুদ্ধমতে নিত্য আত্মার নিষেধ করা হলেও জন্মান্তরে
বিশ্বাসী। এ মতে পুনর্জন্মের অর্থ এক আত্মার অন্য শরীরে প্রবেশ করা বা চিরন্তন আত্মার
নতুন দেহ ধারণ নয়, বরং পুনর্জন্মের অর্থ হচ্ছে বিজ্ঞানপ্রবাহের অবিচ্ছিন্নতা।
যখন
একটি বিজ্ঞানপ্রবাহের অন্তিম বিজ্ঞানটি সমাপ্ত হয় তখন অন্তিম বিজ্ঞানের মৃত্যু হয়,
এবং একটি নতুন শরীরে একটি নতুন বিজ্ঞানের প্রাদুর্ভাব হয়। একে বুদ্ধ পুনর্জন্ম বলেছেন।
কেবলমাত্র বর্তমান জীবন থেকে পরবর্তী জীবনের উদ্ভব হয়। অর্থাৎ কোন আত্মাই নেই যা দেহ
পরিবর্তন করে।
একমাত্র
ব্যক্তির চরিত্রই চলমান থাকে। যে ব্যক্তির পুনর্জন্ম হয়েছে সে মৃত ব্যক্তির কর্মের
উত্তরাধিকারী। কিন্তু সে এক নতুন মানুষ। কোন স্থায়ী অভেদ না থাকলে বিনাশ বা বিচ্ছিন্নতাও
নেই। নতুন জীব হলো তাই, তার কর্ম তাকে যেরকম করেছে। এক্ষেত্রে বুদ্ধ পুনর্জন্মের ব্যাখ্যায়
দীপকজ্যোতির দৃষ্টান্ত গ্রহণ করেছেন।
দুটি
প্রদীপ সম্পূর্ণ ভিন্ন হলেও যেমন একটি দীপ হতে অন্য দীপকে প্রজ্বলিত করা যায়, সেরূপ
বর্তমান জীবনের অন্তিম অবস্থা হতে ভবিষ্যৎ জীবনের প্রথম অবস্থার বিকাশ সম্ভব। এভাবেই
জন্ম থেকে জন্মান্তরের একটি ধারাবাহিকতার স্রোত বয়ে চলেছে যার জন্য কোন সনাতন বা নিত্য
আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করার প্রয়োজন নেই।
অনুরূপভাবে
বিভিন্ন মানসিক অবস্থার মধ্যে ধারাবাহিকতা মেনে নিয়ে বৌদ্ধমতে স্মৃতির ব্যাখ্যাও সম্ভব।
পূর্ববর্তী মানসিক ক্রিয়া থেকেই উৎপন্ন হয় পরবর্তী মানসিক ক্রিয়া। যেহেতু পূর্ববর্তী
মানসিক ক্রিয়ার পূর্ণ বিলোপ হয় না, তার ছাপ বা চিহ্ন থেকে যায়।
সুতরাং
সেটাই স্মৃতিরূপে প্রকট হয় যখন পরবর্তী মানসিক ক্রিয়া চলতে থাকে। পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাপ
রেখে যায় পরবর্তী অভিজ্ঞতার মধ্যে। বৌদ্ধমতে এই স্মৃতির ব্যাখ্যার জন্য কোন স্থায়ী
আধারের প্রয়োজন নেই। কোন আধারের মধ্যে মানসিক অভিজ্ঞতাগুলির ছাপ সংরক্ষিত হয় না। আবার
এই মতে নৈতিক দায়িত্ব ব্যাখ্যা করার জন্য এক ও অভিন্ন ব্যক্তিত্ব স্বীকার করার কোন
প্রয়োজন নেই।
বৌদ্ধদর্শনে
নিত্য আত্মার অস্তিত্ব স্বীকৃত নয় বলে তাকে অনাত্মবাদী দর্শন বলে। এমনকি বৌদ্ধদর্শনে
পরিবর্তনশীল দৃষ্ট ধর্মের অতিরিক্ত কোন অদৃষ্ট দ্রব্যের সত্তা স্বীকৃত নয়। বুদ্ধ বলেছেন,
যদি আত্মাকে নিত্য স্বীকার করা হয় তবে আসক্তি বাড়বে এবং দুঃখ উৎপন্ন হবে। ভ্রান্ত ব্যক্তিই
আত্মাকে সত্য বলে মানে, ফলে তার প্রতি আসক্তি বাড়ে। তাঁর মতে আত্মা সম্পর্কে আলোচনা
থেকে সবসময় বিরত থাকতে হবে, কারণ এই আলোচনা নিরর্থক।
বুদ্ধের
প্রতীত্য-সমুৎপাদ তত্ত্ব অনুযায়ী সমস্ত কার্যকারণাত্মক জগৎ হচ্ছে প্রতীত্য-সমুৎপন্ন,
অর্থাৎ সংসারের সমস্ত বস্তুর অস্তিত্ব ক্ষণমাত্র এবং পরিবর্তনশীল।
বুদ্ধমতে এই সংসার প্রতীত্য-সমুৎপাদের নিয়মে সঞ্চালিত হয়। সারা বিশ্ব উৎপত্তি ও বিনাশের নিয়মাধীন।
বুদ্ধের দশ অ-কথনীয় (indeterminable questions):
বুদ্ধ ছিলেন মূলত একজন সমাজসংস্কারক, ধর্মপ্রচারক। কিন্তু অধিবিদ্যা বা আধ্যাত্মবাদে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না। তাই ঈশ্বর, আত্মা, জগৎ প্রভৃতি বিষয়ের দার্শনিক বিচারে তাঁর কোন আগ্রহ ছিলো না। তাঁর নীতিশিক্ষা পর্যালোচনা করলে তাতে নীতিবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, তর্কশাস্ত্র প্রভৃতির উপস্থিতি দেখা গেলেও সেখানে তত্ত্বদর্শন বা অধিবিদ্যা অনুপস্থিত। বরং দর্শন শাস্ত্রের কোন প্রশ্ন করা হলে তিনি তখন মৌন থেকে আত্মা, জগৎ ইত্যাদি সম্পর্কিত জনপ্রিয় প্রশ্নের প্রতি ঔদাসীন্য প্রকট করেছেন। এই মৌনতার অর্থ হচ্ছে তা ‘অতিপ্রশ্ন’, যার প্রতিপাদন করা কেবল দুরূঢ়ই নয়, অনাবশ্যকও।
এ
বিষয়ে বুদ্ধ অতি সুন্দর উপমাসূচক দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। ব্রাহ্মণদের আত্মবাদ বিষয়ে ‘দীর্ঘনিকায়ে’র ‘পোট্ঠপাদ সূত্তে’ বলা হয়েছে-
আত্মাকে
স্বর্গসুখ ভোগ করতে কে দেখেছে? না দেখে তার অস্তিত্ব স্বীকার করা নিতান্ত উপহাস্যস্পদ।
যদি কোন পুরুষ বলে যে, সে এই দেশের যে জনপদকল্যাণী (দেশের সুন্দরতম স্ত্রী) তাকে চায়।
তাতে লোকে তাকে প্রশ্ন করে, যে স্ত্রীকে সে চায় সে কি ক্ষত্রিয়াণী, ব্রাহ্মণী, বৈশ্যস্ত্রী
বা শূদ্রী? অমুক নামধারী বা অমুক গোত্রধারী, লম্বা বা বেটে বা মাঝারি? এরূপ প্রশ্নে
‘না’ বললে (তাকে হয়তো নির্বোধ
বা পাগল ঠাউরে) কেউ সেই বাক্যের কোন প্রমাণ চায় না। এরূপ আত্মবাদী ব্রাহ্মণবাক্যের
প্রমাণ চাওয়া হয় না।
দ্বিতীয়
দৃষ্টান্তটি আরো সুন্দর। কোন ব্যক্তি প্রাসাদে আরোহণের জন্য চৌরাস্তায় সিঁড়ি বানালে
লোকেরা তাকে জিজ্ঞাসা করে, ওহে! তুমি যে প্রাসাদের জন্য সিঁড়ি বানাচ্ছো, তুমি কি জানো
সেই প্রাসাদটি পূর্ব দিকে, দক্ষিণ দিকে, পশ্চিমদিকে বা উত্তরদিকে? উঁচু, নিচু বা মাঝারি?
এই প্রশ্নের উত্তরে ‘না’ বললে তাকে বলা হয় যে, যাকে
তুমি জানো না, দেখোনি সেই প্রাসাদে চড়ার জন্য সিঁড়ি বানাচ্ছো? যদি এই প্রশ্নের উত্তরে
‘হাঁ’ বলা হয় তবে কি তার বাক্য
প্রমাণশূন্য হবে না?
এই
উদাহরণে বুদ্ধ দেখিয়েছেন যে, ব্রাহ্মণদর্শনে প্রতিপাদিত ‘আত্মা’ নামক কোন পদার্থ নেই। কেননা যখন কেউ
আত্মাকে দেখেনি, শোনেনি তখন তার অস্তিত্ব কিভাবে স্বীকার করা হয়? পরলোকে সেই আত্মাকে
সুখী বানাতে যে উপায় গ্রহণ করা হয় তা কি নিরর্থক নয়? কেননা যার মূল নেই তাকে সিঞ্চন
করা প্রয়োজন হয় না।
বুদ্ধ
একজন সমাজসংস্কারকই ছিলেন, দার্শনিক নন। তাই যখনই তাঁকে দর্শন শাস্ত্রের কোন প্রশ্ন
করা হতো তখন তিনি মৌন থেকেছেন।
শ্রাবস্তীর
জেতবনে বিহার করার সময় মোগ্গলিপুত্ত তিস্স বুদ্ধকে দশটি প্রশ্ন করেছিলেন, যার উত্তরে
বুদ্ধ নিস্পৃহ থেকেছিলেন। এগুলোকেই বুদ্ধের দশ অ-কথনীয় বলা হয়। মজ্ঝিমনিকায় অনুসারে
বুদ্ধের অকথনীয় সূচিতে মাত্র দশটি বাক্য আছে, যা লোক (বিশ্ব), আত্মা এবং শরীরের ভেদাভেদ
তথা মুক্ত পুরুষের গতি বিষয়ক। এই প্রশ্নগুলো হলো-
(ক) লোক বিষয়ক:
- (১) লোক শাশ্বত বা নিত্য (eternal) কি-না ?
- (২) লোক কি অনিত্য
(non-eternal) ?
- (৩) লোক কি সসীম
(finite) ?
- (৪) লোক কি অসীম
(infinite) ?
(খ) দেহাত্মার একতা বিষয়ক:
- (৫) আত্মা ও শরীর কি এক ?
- (৬) আত্মা ও শরীর কি ভিন্ন ?
(গ) নির্বাণ-পরবর্তী অবস্থা বিষয়ক:
- (৭) মৃত্যুর পর তথাগতের কি পুনর্জন্ম হয়েছে ?
- (৮) মৃত্যুর পর কি তথাগতের পুনর্জন্ম হয় নি ?
- (৯) তথাগতের পুনর্জন্ম হওয়া বা না হওয়া- উভয়ই কি সত্য ?
- (১০) তথাগতের পুনর্জন্ম হওয়া বা না হওয়া- উভয়ই কি অসত্য ?
বিভিন্ন সময়ে বুদ্ধের এ মৌনতার ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা হয়েছে। কোন কোন পণ্ডিতের মতে বুদ্ধের এই নীরবতা তত্ত্ববিষয়ক অজ্ঞানের প্রতীক। কিন্তু এ মত গ্রহণযোগ্য নয় এজন্যেই যে, তত্ত্বশাস্ত্রীয় প্রশ্নের উত্তর না জানলে তিনি ‘বুদ্ধ’ সংজ্ঞায় বিভূষিত হতেন না। বুদ্ধ শব্দের অর্থ জ্ঞানী। আবার কারো কারো মতে বুদ্ধ আত্মা, জগৎ, ঈশ্বর ইত্যাদির অস্তিত্বে সন্দিগ্ধ ছিলেন বলে এই মৌনতা তাঁর সংশয়বাদের স্বীকৃতি। কিন্তু তাঁদের এ ধারণা যে সম্পূর্ণই অর্বাচীন তার প্রমাণ হলো বুদ্ধের অনিত্যবাদ, অনাত্মবাদ, নিরীশ্বরবাদের মধ্য দিয়ে এই বহমান জগতের কোনো বস্তুকেই ধ্রুব বা নিত্য বলে স্বীকার না করা।
অনেক
পণ্ডিত বুদ্ধের মৌন থাকাকে উদ্দেশ্যমূলক আখ্যায়িত করে বলেন, বুদ্ধ ছিলেন সর্বজ্ঞানী।
তিনি তত্ত্বশাস্ত্রের প্রশ্নোত্তর জানতেন এবং মানবজ্ঞানের সীমাও জানতেন। তিনি বুঝেছিলেন
যে, তত্ত্বশাস্ত্রীয় যত প্রশ্ন আছে তাদের নিশ্চিতভাবে উত্তর হয় না।
এরকম
কোন প্রশ্নের উত্তরে দার্শনিকরাও এক মত নন। তত্ত্বশাস্ত্রের প্রশ্নে সৃষ্ট ঝঞ্ঝাট ব্যর্থ
বিবাদকে প্রশ্রয় দেয়। কেননা অন্ধগণ স্পর্শ করে হাতির স্বরূপ বর্ণনা করলে সেই বর্ণনা
বিরোধাত্মক ও ভিন্ন ভিন্ন হয়। তাই তিনি তত্ত্বশাস্ত্রীয় প্রশ্নের প্রতি মৌন থেকে নিস্পৃহতা
প্রদর্শনের মাধ্যমে বুঝিয়েছেন যে, সে সব প্রশ্নের উত্তর ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণে নিষ্প্রয়োজন।
বুদ্ধমতে এসব অব্যাকৃত প্রশ্নে আগ্রহী হওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। এসব তত্ত্বশাস্ত্রীয়
প্রশ্নের উত্তরে ব্যবহার বা নীতিমার্গের কোন সমস্যার সমাধান হয় না।
বুদ্ধের
মতে সংসার দুঃখে পরিপূর্ণ। দর্শনের উদ্দেশ্য হচ্ছে দুঃখের সমাপ্তি সন্ধান। সেকারণে
তিনি দুঃখের সমস্যা ও দুঃখনিরোধের উপর অধিক জোর দিয়েছেন। তাই মালুঙ্ক্যপুত্ত যখন বুদ্ধকে
এই দশ অকথনীয় সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলেন- “ভগবন্ ! যদি এ বিষয়ে জানেন …তবে বলুন …না
জানলে …বা যিনি জানেন না বা বোঝেন না তাঁকে সরাসরি বলে দেওয়াই যুক্তিসংগত- ‘আমি জানি
না।’ …”
বুদ্ধ
এর উত্তর দিতে গিয়ে বলেছেন- “…আমি একে অ-কথনীয় …বলেছি, …কারণ …এর সম্বন্ধে আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ
নয়, ভিক্ষুচর্যা বা ব্রাহ্মচর্যের জন্য যোগ্য নয়। আবার নির্বেদ-বৈরাগ্য, শান্তি …পরম-জ্ঞান
ও নির্বাণপ্রাপ্তির জন্যও এই অ-কথনীয়ের কোনো আবশ্যকতাই নেই; তাই আমি এদের বলেছি অবক্তব্য।” (দর্শন-দিগদর্শন/ রাহুল সাংকৃত্যায়ন)
তবে
কোন বৌদ্ধ চিন্তার পাকে আটকে না থেকে স্বাধীন চিন্তার পক্ষেই বুদ্ধের সম্মতি ও উপদেশ
পরিলক্ষিত হয়। যেমন (মজ্ঝিমনিকায়-১/২/৩) বুদ্ধ উপদেশ শুরু করেছিলেন এভাবে-
“ভিক্ষুগণ! আমি সেতুর মতো অতিক্রম
করার জন্য তোমাদের ধর্মোপদেশ দিচ্ছি, ধরে রাখার জন্য নয়। …যেমন, একজন পুরুষ …এমন এক
বিরাট নদীর ধারে উপস্থিত হলো যার এপার বিপদসঙ্কুল, ভয়পূর্ণ এবং ওপার সুখ-সমৃদ্ধিপূর্ণ
তথা ভয়রহিত। অথচ সেখানে যাওয়ার জন্য কোনো তরীও নেই, নেই কোনো সেতু। …তখন সে …তৃণ-কাষ্ঠ
…পত্র সংগ্রহ করে সেতু বেঁধে, তার সাহায্যে দৈহিক পরিশ্রমের দ্বারা স্বস্তিপূর্বক নদী
পার হলো। …এরপর তার মনে হলো- ‘এই সেতু আমার উপকার করল, এর সাহায্যে …আমি পার হলাম;
অতএব এখন একে আমি কেনই বা মাথায় করে অথবা কাঁধে তুলে… নিয়ে যাব না।’ …তবে কি …ঐ পুরুষকে সেতুটির
প্রতি কর্তব্য পালনকারী ধরতে হবে? …না…। ভিক্ষুগণ! ঐ পুরুষ সেতুটি
থেকে দুঃখকেই আহরণ করবে।”
একবার
বুদ্ধকে কেশপুত্র গ্রামের কালামো নানা মতবাদে সত্য-মিথ্যা সন্দেহ করে প্রশ্ন করেছিলেন-
“প্রভু! কোনো কোনো শ্রমণ-ব্রাহ্মণ কেশপুত্র গ্রামে এসে নিজ নিজ মতবাদ প্রকাশ…করেন, অন্যের মতবাদে দ্বি-মত হন, নিন্দা
করেন।… অন্যেরাও…স্বীয় মতবাদ প্রকাশ করে…অন্যের মতবাদে তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করেন।
অতএব…আমার মনে এরূপ দ্বিধা হয়-
এঁদের মধ্যে…কে সত্য বলেন কেই বা মিথ্যা
বলেন?’
উত্তরে বুদ্ধ বলেন- “‘কালামো! তোমার সন্দেহই…ঠিক, যেখানে প্রয়োজন সেখানেই সন্দেহ করেছ। …কালামো! তুমি শ্রুত কথার (বেদের) ভিত্তিতে কারুর কথা মেনে নিও না; তর্কের খাতিরে, বিনা যুক্তিতে, বক্তার ভব্যরূপে মুগ্ধ হয়ে, নিজের পুরনো সিদ্ধান্তের অনুকূল বলে, এই শ্রমণ আমার গুরু’ বলে মেনে না নিয়ে, নিজের বিচারে যা তুমি ধর্মসংগত, উত্তম, নির্দোষ, অনিন্দিত মনে করবে, যাকে গ্রহণ করা হিতকর ও সুখকর বলে জানবে নির্দ্বিধায় তাকে স্বীকার কর।”(alert-success)
এদিকে
বুদ্ধের সমসাময়িক বর্ধমান মহাবীরকে সর্বজ্ঞ, সর্বদর্শী বলা হয়, যার প্রভাব পরবর্তীযুগের
বৌদ্ধদর্শনের ওপরেও যে পড়েছিলো তা বলা বাহুল্য। তবুও বুদ্ধ স্বয়ং যে সর্বজ্ঞতার ধারণার
বিরোধী ছিলেন তা মজ্ঝিমনিকায়ে বুদ্ধের উপদেশেই পরিলক্ষিত হয়-
বাৎস্যগোত্র
প্রশ্ন করেছিলেন- “‘প্রভু! শুনেছি শ্রমণ গৌতম সর্বজ্ঞ, সর্বদর্শী… -(যিনি এ কথা বলেন) …তিনি কি যথার্থই
বলেন? মিথ্যাচরণ দ্বারা …ভগবানের নিন্দা করেননি তো?’
“বাৎস্য! আমার সম্পর্কে যিনি
এরূপ মত পোষণ করেন …তিনি যথার্থ বলেন না। মিথ্যা দ্বারা …আমার নিন্দাই করেন।” (মজ্ঝিমনিকায়-২/৩/১)
আবার
অন্যত্র দেখা যায়, বুদ্ধ বলেছেন- “এমন কোনো শ্রমণ-ব্রাহ্মণ নেই, যিনি একেবারেই সব জানবেন
ও দেখবেন; অর্থাৎ সর্বজ্ঞ, সর্বদ্রষ্টা হবেন।” (মজ্ঝিমনিকায়-২/৪/১০)
আমাদের কমেন্ট করার জন্য ধন্যবাদ। আমরা আপনার কমেন্ট পড়া মাত্র প্রতিক্রিয়া জানাতে চেষ্টা করবো।