মহাকারুণিক গৌতমবুদ্ধের জীবন
পৃথিবীতে যখনই মানবতা ভূলুণ্ঠিত হয়, মনুষ্যত্ব ভুলে গিয়ে মানুষ অধর্মের পথে চালিত হয়, তখন জগতবাসীকে সৎ শিক্ষাদান এবং সৎপথে পরিচালিত করার উদ্দেশ্যে আবির্ভূত হন একেকজন মহাপুরুষ। সেরূপ বুদ্ধের আবির্ভাবও বিশ্ববাসীর জন্যে ছিল এক মহাদুর্লভ ঘটনা। আর এই মহানব্যক্তিই হলেন বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তক গৌতমবুদ্ধ। তাঁর জীবনদর্শনই বৌদ্ধধর্মের মূলভিত্তি।
জন্ম থেকে মহাপরিনির্বাণ
লাভ পর্যন্ত সুদীর্ঘ আশি বছরব্যাপী জীবনে বুদ্ধ নৈতিকতা ও মানবতার বহু বিরল দৃষ্টান্ত
রেখেছেন। তাঁর জীবন ছিল মৈত্রী-করুণার রসে সিক্ত। জীবপ্রেম, অহিংসা, সাম্য, মৈত্রী
ও করুণার বাণী প্রচার করে তিনি মহাকারুণিক বুদ্ধ’ নামে খ্যাত হন।
শাক্যদের পরিচিতি:
কোশলের রাজা ছিলেন
ইক্ষাকু। শাক্যরা ছিলেন ইক্ষাকু বংশীয়। ইক্ষাকুরা সূর্যবংশ থেকে এসেছিলেন। সূর্যবংশীয়
এক রাজার দুই রানি ছিল। এঁদের মধ্যে ছোট রানি ছিলেন দুষ্ট প্রকৃতির ও স্বার্থপর। তাঁর
পরামর্শে রাজা বড় রানির ছেলে-মেয়েদের বনবাসের আদেশ দেন। তাই রাজপুত্র ও রাজকন্যারা
রাজপ্রাসাদ ছেড়ে হিমালয়ের বনাঞ্চলে গিয়ে বসতি স্থাপন করেন। এখানে কপিলমুনির সাধনাস্থল
ছিল। তাই এ স্থানের নাম হয়েছিল কপিলাবস্তু। শালবন পরিবেষ্টিত সমতলভূমিতে তাঁদের বংশধরদের
বসবাস। ফলে তারা শাক্য নামে পরিচিত হন।
কপিলাবস্তু নগরীরপরিচিতি
এককালে শাক্যরা
শৌর্য-বীর্যে ও সমৃদ্ধিতে প্রাধান্য লাভ করেছিলেন। ধীরে ধীরে তাঁরা অনেক জায়গা অধিকার
করে নেন। এতে তাঁদের আবাসভূমি অনেক দূর বিস্তৃতি লাভ করে। উত্তরে হিমালয়, পূর্বে মগধ
ও লিচ্ছবী এবং পশ্চিমে কোশল রাজ্যেও মধ্যবর্তী যে-ভূভাগে শাক্যরা রাজত্ব করতেন সেটাই
ছিল শাক্যরাজ্য।
বর্তমান নেপাল
রাজ্যের তরাই অঞ্চলটিকে প্রাচীন কপিলাবস্তুরূপে চিহ্নিত করা হয়েছে। কপিলাবস্তু নগরী
শাক্যরাজ্যের রাজধানী ছিল। এর পাশ দিয়ে রোহিনী নদী প্রবাহিত ছিল। শাক্যরা ক্ষত্রিয়
হলেও কৃষিকাজ ছিল তাঁদের প্রধান উপজীবিকা। শাক্যরাজ্যের রাজপদ বংশগত ছিল না। শাক্যরা
স্বগোত্রের প্রধানকে রাজা নির্বাচিত করতেন।
সেই কপিলাবস্তু
নগরে রাজা জয়সেন রাজত্ব করতেন। তাঁর পূর্বেকার রাজাদের পরিচয় পাওয়া যায়নি। রাজা
জয়সেনের সিংহ-হনু ও যশোধরা নামে দুই পুত্রকন্যা ছিল। রাজা সিংহ-হনু ও রানি কাত্যায়নীর
সাত পুত্রকন্যা ছিল। যথাক্রমে পুত্রদের নাম হলো- শুদ্ধোদন, অমিতোদন, ধৌতোদন, শুক্লোন,
অশুক্লোদন এবং কন্যাদের নাম হলো- অমিতা ও প্রমিতা। রাজা শুদ্ধোদন ও রানি মহামায়ার
ঔরসজাত সন্তান ছিলেন সিদ্ধার্থ গৌতম ।
জীবন বৃত্তান্ত
জন্ম কাহিনী
হিমালয়ের পাদদেশে
কপিলাবস্তু ছিল সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ রাজ্য। এ রাজ্যের রাজার নাম শুদ্ধোদন, রানি মহামায়াদেবী।
রাজ্যে সুখ শান্তির অভাব ছিল না। কিন্তু রাজা ও রানির মনে শান্তি নেই। কারণ, তাঁদের
কোনো সন্তান নেই। একটি সন্তানের আশায় রাজা-রানি অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিলেন। কপিলাবস্তু
নগরীতে এক সপ্তাহ ব্যাপী আষাঢ় উৎসব চলছিল। আষাঢ়-উৎসব শেষ করে রানি মায়াদেবী ঘুমিয়ে
পড়লেন। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ ছিল। চাঁদের আলোয় চারিদিক উদ্ভাসিত।
মহামায়র স্বপ্ন দর্শনের কল্পিত চিত্র |
সেই রাতে রানি
এক অপূর্ব সুন্দর স্বপ দেখলেন। চারদিক থেকে চার দিকপাল দেবতা এসে রানিকে সোনার পালঙ্কে
তুলে নিলেন। নিয়ে গেলেন হিমালয় পর্বতের মানসসরোবরে। ওখানে দেবতাদের মহিষীরা মায়াদেবীকে
স্নান করিয়ে সুবাসিত দিব্যবস্ত্রে ভূষিত করলেন। রানি আরো দেখলেন তিনি সোনার পালঙ্কে
শুয়ে আছেন। পাশের স্বর্ণপর্বত থেকে এক শ্বেতহস্তী নেমে এল, শুঁড়ে ছিল একটি শ্বেতপদ্ম।
শ্বেতহস্তীটি রানির পালঙ্কের চারপাশে তিনবার প্রদক্ষিণ করল। এরপর রানির মাতৃজঠরের দক্ষিণ
দিকে শ্বেতপদ্মটি প্রবেশ করিয়ে দিল। অলৌকিক আনন্দে শিহরিত হলেন রানি।
ঋষি ও জ্যোতিষীরভবিষ্যদ্বাণী
পরদিন ঘুম থেকে
জেগে রানি তাঁর স্বপ্নের কথা রাজা শুদ্ধোদনকে বললেন। রাজা সকল রাজ-জ্যোতিষীকে ডেকে
স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে চাইলেন। তাঁরা বললেন, “মহারাজ! সুসংবাদ আছে, আনন্দ করুন, রানি
মায়াদেবীর পুত্রসন্তান হবে। শাক্যবংশে এক মহাপুরুষের আবির্ভাব হবে। কালে তিনি সর্বজীবের
দুঃখহরণকারী মহাজ্ঞানী হবেন। আনন্দ করুন মহারাজ।”
লুম্বিনী কাননেজন্ম
শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা
তিথি। এ সময় রানির পিতৃগৃহে যাওয়ার ইচ্ছা হলো। রাজা সম্মতি দিলেন এবং পিতৃগৃহে যাওয়ার
ব্যবস্থা করলেন। রানির যাত্রাপথ কপিলাবস্তু থেকে দেবদহ পর্যন্ত সজ্জিত ও সমতল করা হলো।
সখীদের সঙ্গে নিয়ে রানি সোনার পালকিতে চড়ে পিত্রালয়ে চললেন।
লুম্বিনি কাননে সিদ্ধার্থের জন্ম |
পথে দুই নগরের
মাঝে লুম্বিনীকানন। শালবিথীকায় ঘেরা, চারিদিকে ফুল-পাতার সমারোহ, পাখির কলকাকলিতে
মুখর ছায়াশীতল কাননে রানির বিশ্রামের ইচ্ছা হলো। তাঁর নির্দেশে পালকি থামানো হলো।
রানি কিছুদূর হেঁটে
এক শালবৃক্ষের নিচে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে একটি শাখা ধরলেন। তখনই তাঁর প্রসববেদনা শুরু
হলো। সহচরীরা জায়গাটির চারদিকে কাপড় দিয়ে ঘিরে দিলেন। লুম্বিনী কাননের শালবৃক্ষের
নিচে বৈশাখী পূর্ণিমার শুভক্ষণে জগতের আলো ভাবী বুদ্ধ সিদ্ধার্থ গৌতম ভূমিষ্ট হলেন।
শিশুর নামকরণ
পুত্রের নাম রাখা
হলো সিদ্ধার্থ। কথিত আছে, সিদ্ধার্থ জন্মগ্রহণ করেই সাতটি পদক্ষেপে অগ্রসর হয়েছিলেন,
আর প্রতি পদক্ষেপে একটি করে পদ্মফুল ফুটেছিল। এ সময় চারদিকে দেবতারা আনন্দধ্বনি উচ্চারণ
করেছিলেন ‘জগতে সিদ্ধার্থ জন্মগ্রহণ করেছেন। কথিত আছে যে, একই দিনে গয়ার বোধিবৃক্ষ,
রাহুলমাতা গোপাদেবী, চার নিধিকুম্ভ, চার মঙ্গলহস্তী, অশ্বরাজ কন্থক, সারথি ছন্দক ও
অমাত্যপুত্র উদায়ীও জন্মগ্রহণ করেন। সিদ্ধার্থের জীবনের সাথে এদের বিশেষ সম্পর্ক ছিল।
শিশু কুমারকে নিয়ে
মহাসমারোহে রানি কপিলাবস্তু ফিরে এলেন। রাজ্যে খুশির বন্যা বয়ে গেল। উৎসবে মেতে উঠল
নগরবাসী। বোধিসত্নের জন্ম সংবাদ পেয়ে হিমালয় থেকে নেমে এলেন ঋষি অসিত। রাজকুমার
সিদ্ধার্থের জন্মের পরে তাঁকে দেখতে এলেন এ ঋষি। তিনি মহর্ষি কালবেল নামেও পরিচিত ছিলেন।
তিনি শিশু রাজকুমারকে দেখে অভিভূত হয়ে প্রথমে উল্লাস প্রকাশ করলেন। একটু পরেই তাঁর
দু'চোখ অশ্রুতে ভিজে গেল। মহারাজ উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইলেন তাঁর এই অকস্মাৎ আনন্দ
ও বিষাদের কারণ।
ঋষি অসিত বললেন,
মহারাজ, এই কুমার মহাজ্ঞানী বুদ্ধ হবেন, জগৎকে দুঃখমুক্তির পথ প্রদর্শন করবেন। এজন্যে
আমি উল্লসিত হয়েছি। কিন্তু আমি বয়োবৃদ্ধ। বুদ্ধের অমিয়বাণী শোনার সৌভাগ্য আমার
হবে না, বহুপূর্বেই আমার মৃত্যু হবে। এজন্যে মন বিষন্নতায় ভরে উঠল।
সত্যি এই আনন্দ-বিষাদের
ছায়া নেমে এল। রানি মায়াদেবী সাত দিন পরে মারা গেলেন। শিশু সিদ্ধার্থের লালন পালনের
ভার নিলেন বিমাতা মহাপ্রজাপতি গৌতমী। তিনি মায়াদেবীর সহোদরা ছিলেন। গৌতমীর দ্বারা
সিদ্ধার্থ লালিত পালিত হয়েছিলেন বলে তিনি সিদ্ধার্থ গৌতম’ নামে পরিচিত। পরবর্তীতে
বিশ্বে তিনি গৌতম বুদ্ধ' নামেই পরিচিত হন।
সিদ্ধার্থের বাল্যকাল
বিমাতা গৌতমীর
পরিচর্যায় সিদ্ধার্থ পরম যত্নে বড় হতে লাগলেন। পোষা শশক ও মৃগশাবক, মরাল ও ময়ূর
ছিল তাঁর খেলার সাথী। প্রাসাদ ও উদ্যানের অনুপম পরিবেশে শৈশবের দিনগুলো তাঁর আনন্দেই
কাটছিল।
রাজা কুমারকে চোখের
আড়াল করতে চাইতেন না। একবার নগরে হলকর্ষণ-উৎসব হচ্ছে। ঐদিন রাজা এবং অমাত্য ও সম্ভান্তরা
নিজের হাতে হাল বা লাঙল চালান করে সারা বছরের কৃষি কাজের শুভসূচনা করতেন।
রাজা কুমারকে নিয়ে
উৎসবে যোগ দিলেন। এখানেই কুমার প্রত্যক্ষ করলেন, হলকর্ষণে ভেজা মাটি থেকে বেরিয়ে
পড়া পোকামাকড়গুলোকে পাখিরা খেয়ে যাচ্ছে, ব্যাঙ এসে খাচ্ছে। একটা সাপ এসে ব্যাঙটিকে
গিলে ফেলল। আবার কোথা থেকে একটা চিল উড়ে এসে সাপটিকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল। চোখের সামনে
ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো সিদ্ধার্থকে উদ্বিগ্ন করে তুলল। বেঁচে থাকার জন্যে মানুষ ও প্রাণিকুলের
এ নিষ্ঠুরতার কথা ভাবতে ভাবতে তিনি কোলাহল থেকে নির্জনে চলে গেলেন।
এক বিশাল জম্বুবৃক্ষের
ছায়ায় বসে গভীর ধ্যানে নিমগ্ন হলেন। এদিকে হলকর্ষণ-উৎসব শেষ, এবার সকলের বাড়ি ফেরার
পালা। কিন্তু কুমার কোথায়! চারদিকে খোঁজার পরে তাঁকে পাওয়া গেল জম্বুবৃক্ষের ছায়ায়
ধ্যানে মগ্ন।
জ্যোতির্ময় আভায়
উদ্ভাসিত কুমারের অবয়ব। রাজা ও অন্যেরা এ দৃশ্য দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়েন।
অভাবিত এ ঘটনায় রাজাসহ সকলে বিহ্বল হলেন। রাজা শুদ্ধোদন পুনরায় স্মরণ করলেন ঋষি অসিতের
ভবিষ্যদ্বাণী। ধ্যানভঙ্গ হলে রাজা পুত্রকে নিয়ে প্রাসাদে ফিরে এলেন।
বিদ্যাশিক্ষা
বড় বড় পণ্ডিতের
কাছে তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হলো। ব্রাহ্মণপুত্র বিশ্বামিত্রের কাছে তাঁর প্রথম বিদ্যাশিক্ষা
শুরু হয়। বর্ণ পরিচয়ের প্রারম্ভেই সিদ্ধার্থ তাঁর অতুলনীয় প্রতিভা প্রদর্শন করেন।
প্রতিটি বর্ণ উচ্চারণের সাথে সাথে সেই বর্ণসমন্বিত একটি করে নীতিবাক্য উচ্চারিত হলো
তাঁর মুখ দিয়ে ক্রমে তিনি নানাবিধ ভাষা, শাস্ত্র ও চৌষট্টি প্রকার লিপিবিদ্যায় পারদর্শিতা
অর্জন করেন। বেদ, পুরান, ইতিহাস, যোগ, বৈশেষিক, ন্যায়, গণিত, চিকিৎসাবিদ্যা ইত্যাদি
শাস্ত্র আয়ত্ত করলেন।
রাজ দরবারে রাজপুত্র সিদ্ধার্থ |
একই সঙ্গে রাজনীতি,
মৃগয়া, অশ্বচালন, ধনুর্বিদ্যা, রথচালন ইত্যাদি ক্ষত্রিয়োচিত দক্ষতাও আয়ত্ত করলেন।
তবে তিনি কিছু ব্যতিক্রম আচরণ দেখালেন। যেমন অশ্বচালনায় জয়লাভ করার পূর্বক্ষণে ঘোড়ার
রাশ ছেড়ে দিলেন, প্রতিদ্বন্দ্বী দেবদত্তকে বিজয়ী হওয়ার সুযোগ দিলেন। একবার মৃগয়ায়
গিয়ে হাতের কাছে পেয়েও শিকার ছেড়ে দিলেন। এতে সঙ্গীরা বিরক্ত হলেও অসহায় হরিণ শিশুর
প্রাণরক্ষা হওয়ায় তিনি আনন্দিত হলেন।
সিদ্ধার্থের জীবপ্রেম
একদিন উদ্যানে
বসে কুমার প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করছিলেন। নীল আকাশে একদল সাদা হাঁস উড়ে যাচ্ছিল।
সিদ্ধার্থ মুগ্ধ হয়ে ঐ সুন্দর দৃশ্য দেখছিলেন। হঠাৎ তীরবিদ্ধ হয়ে একটি সাদা হাঁস
তাঁর কোলে এসে পড়ল, রক্তাক্ত হাঁসটি যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। তীরবিদ্ধ হাঁসের কষ্ট দেখে
সিদ্ধার্থের অন্তর করুণা উৎপন্ন হলো।
তিনি সযত্নে তীরটি
ছাড়িয়ে নিলেন। সেবা শুশ্রষা করে হাঁসটিকে বাঁচিয়ে তুললেন। এমন সময় আরেক রাজকুমার
দেবদত্ত এসে হাঁসটি দাবি করল। তিনি বলল, কুমার, হাঁসটি আমার, আমি তীরবিদ্ধ করেছি। হাঁসটি
আমাকে ফিরিয়ে দাও।
সিদ্ধার্থ, হাঁসটি
ফিরিয়ে দিলেন না। তিনি বললেন, তুমি হাঁসটিকে তীরবিদ্ধ করে হত্যা করতে চেয়েছিলে। আমি
ওর জীবন বাঁচিয়েছি। কার অধিকার বেশি? যে জীবন হরণ করতে চায় তার? নাকি যে জীবন দান
করেছে তার? দেবদত্ত কুমারের যুক্তি মানলেন না। বিবাদ বিচারের জন্যে প্রবীণদের কাছে
উত্থাপন করা হলো। প্রবীণরা সিদ্ধার্থ গৌতমের যুক্তিকে সমর্থন করলেন, বললেন, ‘কুমার
যথার্থ বলেছে, যে জীবন দান করেছে হাঁসের ওপর তার অধিকারই বেশি। সিদ্ধার্থ হাঁসটি সুস্থ
করে তুলে উন্মুক্ত আকাশে উড়িয়ে দিলেন।
সিদ্ধার্থ গৌতমের
সুমধুর ব্যবহার, উদারতা, মৈত্রীপূর্ণ আচরণ, প্রজ্ঞাময় দূরদৃষ্টি রাজ অন্তঃপুরবাসী
ও প্রজাসাধারণের অন্তর জয় করেছিল। তিনি হয়ে উঠলেন সকলের প্রিয়।
সিদ্ধার্থের বিবাহ
সিদ্ধার্থ গৌতম
ক্রমে ষোল বছর বয়সে পদার্পণ করলেন। মহারাজ শুদ্ধোদন পুত্রের উদাসীনতা ও বৈরাগ্যভাব
অনুধাবন করে পুত্রকে সংসারী করার তাগিদ অনুভব করলেন। তিনি এক স্বয়ংবর সভার আয়োজন
করলেন। কুমার সিদ্ধার্থ গৌতম রাজসভায় অশোকভাণ্ড পাশে নিয়ে বসলেন।
বিভিন্ন রাজ্য
থেকে সুন্দরী রাজকন্যা ও শ্রেষ্ঠীকন্যারা একের পর এক আসলেন। কুমার অশোকভাণ্ড হতে উপহারসামগ্রী
তাঁদের হাতে তুলে দিলেন। এভাবে সারাদিন কেটে গেল। অশোকভাণ্ড নিঃশেষ, কুমার কোন রাজকন্যাকেই
পছন্দ করতে পারলেন না। আসন ছেড়ে উঠে যাবেন, এমন সময় প্রবেশ করলেন শাক্য প্রবর দণ্ড
পানির কন্যা যশোধরা গোপা।
এদিকে অশোকভাণ্ড
শেষ। কুমার ইতস্তত বোধ করলেন। তখন দণ্ডপাণি-কন্যা যশোধরা মৃদু হেসে জিজ্ঞাসা করলেন,
আমার জন্যে কি কোনো উপহার নেই? রাজপুত্র সিদ্ধার্থ মুহূর্তে নিজ অঙ্গুরীয়টি গোপাদেবীকে
পরিয়ে দিলেন। এ দৃশ্যে সভায় উপস্থিত সকলে আনন্দে মেতে উঠল। যশোধরা গোপার সঙ্গেই
সিদ্ধার্থ গৌতমের পরিণয় হয়ে গেল। মহাধুমধামের সাথে মহারাজ পুত্রের বিবাহ উৎসব করলেন।
চারি নিমিত্ত দর্শন
একসময় সিদ্ধার্থের
নগর ভ্রমণের বাসনা হল। পিতার অনুমতিক্রমে নগর ভ্রমণে বের হয়ে প্রথমে দেখতে পেলেন লাঠির
উপর ভর করে চলমান এক বৃদ্ধলোক। তিনি ছিলেন পলিত কেশ, লোল চর্ম, কম্পিত পদ ও জরাজীর্ণ
বৃদ্ধ।
সিদ্ধার্থের চার নিমিত্ত দর্শন |
দ্বিতীয়বারে দেখলেন
জীর্ণ, শীর্ণ, বিবর্ণ ও চলৎ শক্তিহীন এক যন্ত্রণাকাতর রোগী।
তৃতীয়বারে দেখতে
পেলেন এক মৃত ব্যক্তি যার শবাধার নিয়ে যাচ্ছিল চারজন লোক কাঁধে করে শ্মশানের দিকে।
পেছনে ছুটে চলেছে মৃত ব্যক্তির প্রতিবেশী ও ঘনিষ্ঠজনেরা কেউ ক্রন্দন করে, কেউবা নীরবে।
নগর-ভ্রমণের চতুর্থবারে
সিদ্ধার্থ দর্শন করলেন শান্ত, সৌম্য, সংসার ত্যাগী, গৈরিক বসনধারী অপরূপ এক সন্ন্যাসী।
প্রতিটি দৃশ্যের
পরপরই রথ চালক সারথি ছন্দককে জিজ্ঞাসা করে সিদ্ধার্থ জানতে পারলেন সংসারে মানুষ মাত্রই
যৌবনের অবসানে বৃদ্ধাবস্থা প্রাপ্ত হয়। প্রত্যেককে অবশ্যই রোগাক্রান্ত হতে হয় এবং
জীব মাত্রই মৃত্যুর অধীন। ধনী-নির্ধন, রাজা-প্রজা, দেহধারী সকল প্রাণীরই একই অবস্থা।
এ অবস্থা থেকে কারো রেহাই নেই। এটাই জগতের চিরন্তন রীতি।
সিদ্ধার্থ বুঝতে
পারলেন যে, তিনি নিজেও এ নিয়মের উর্ধ্বে নন, তাঁকেও সব ভোগ করতে হবে এবং তাঁকেও একদিন
মৃত্যুর করাল গ্রাসে পড়তে হবে।
মানুষ! যৌবন-মদে
মত্ত হয়ে মানুষ তার বার্ধক্য দেখতে পায় না, বুঝতে পারে না রোগ-যন্ত্রণা এবং ভয়
করে না জীবনের ভাবী পরিণাম মৃত্যুকে। জন্ম, জরা, ব্যাধি ও মৃত্যুর কাছে মানুষ কতো
অসহায়।
তিনি চিন্তা করলেন
এ সব থেকে মানুষের মুক্তির কি কোন পথ নেই? সারথি ছন্দক থেকে তিনি এটাও জানতে পেরেছেন
যে, প্রশান্ত মূর্তি ঐ সন্ন্যাসীরাই মুক্তির সন্ধানী।
তিনি বুঝতে পারলেন
যে জীব জগতের মুক্তির উপায় খুঁজে বের করার একমাত্র পথ সন্ন্যাসধর্ম অবলম্বন। সিদ্ধার্থের
মনে তুমুল সংগ্রাম শুরু হল। একদিকে দুঃখপূর্ণ সংসারের দুঃখ-মুক্তির হাতছানি, অপরদিকে
স্নেহময় জনক, স্নেহময়ী বিমাতা ও পতিপ্রাণ গোপার মমতার বন্ধন।
নগর ভ্রমণ শেষে
প্রাসাদে ফিরে আসার সময় কৃষ্ণা গৌতমী নামে কোনো এক ক্ষত্রিয় কন্যা সিদ্ধার্থের চেহারা
ও সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তাঁর গুণ কীর্তন করতে করতে বলে উঠলেন।
”নিব্বতো নূন
সা মাতা, নিব্বতো নূন সো পিতা,
নিব্বুতো নূন
সা নারী, যসসায়ং ঈদিসো পতী'তি”
অর্থাৎ, নিবৃত
সেই মাতা, নিবৃত সেই পিতা, যার এরূপ সন্তান আছে। নিবৃত সেই নারী যার এরূপ স্বামী আছে।
ঐ মেয়েটির মুখে ‘নিবৃত' শব্দটি শুনে সিদ্ধার্থ গৌতমের মনে নিবৃত লাভের মনোবাসনা উৎপন্ন
হল।
গৃহত্যাগ
চার নিমিত্ত দর্শনের
পরে সিদ্ধার্থ গৌতমের মনে শান্তি নেই। সব সময়ই তিনি গভীর চিন্তায় মগ্ন থাকতেন। ঐ
তরুণ সন্ন্যাসীর গভীর ধ্যানমগ্ন দৃশ্যটি গৌতমের মনে দাগ কেটেছে। তিনিও দুঃখমুক্তির
সন্ধানে গৃহত্যাগ করবেন সিদ্ধান্ত নিলেন। গৃহত্যাগের আগে তিনি পিতার অনুমতি নেওয়ার
কথা ভাবলেন। পিতার নিকট গিয়ে তিনি তাঁর সংকল্পের কথা জানালেন। পুত্রের কথা শুনে রাজা
যেন বজ্রাহত হলেন। অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করে প্রাণাধিক পুত্রকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি
শাক্যরাজ্যের রাজপুত্র, সিংহাসনের উত্তরাধিকারী, তোমার কিসের অভাব যার জন্যে তুমি
সংসার ত্যাগ করতে চাও? সিদ্ধার্থ উত্তরে বললেন, চারটি বিষয়ে নিশ্চয়তা দিতে পারলে
আমি সংসারত্যাগ করব না:
১. আমি কোনো দিন
জরাগ্রস্ত হব না, চির যৌবনপ্রাপ্ত হব;
২. আমি কোনো দিন
ব্যাধিতে আক্রান্ত হব না;
৩. মৃত্যু কোনো
দিন আমার জীবন কেড়ে নেবে না;
৪. অক্ষয় সম্পদ
যেন আমি লাভ করি।
পুত্রের শর্ত শুনে
রাজা অবাক হয়ে বললেন, এ অসম্ভব! জরা, ব্যাধি, মৃত্যুকে রোধ করা কারো পক্ষে সম্ভব
নয়। এ শর্ত প্রত্যাহার কর পুত্র।
তখন সিদ্ধার্থ
বললেন, মৃত্যুও যে-কোনো সময় আমাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটাতে পারে। যে-গৃহে আগুন লাগে
সে-গৃহ পরিত্যাজ্য। আমি গৃহত্যাগ করার সংকল্প করেছি। রাজা বুঝতে পারলেন মহৎ কর্তব্যসাধনে
পুত্র সংকল্পবদ্ধ, তাঁকে আর বেঁধে রাখা যাবে না। তিনি সিক্ত কণ্ঠে বললেন, পুত্র! তোমার
মনস্কামনা পূর্ণ হোক।
পিতাকে প্রণাম
করে অশ্রুসজল নয়নে সিদ্ধার্থ পিতৃকক্ষ ত্যাগ করলেন।
গোপাদেবীর কোল আলো করে একটি পুত্র সন্তান জন্ম নিল। পুত্রের জন্মের খবর পেয়ে গৌতম নিজের অজান্তে বলে উঠলেন, “রাহু জন্মেছে, বন্ধন উৎপন্ন হয়েছে।' দূতমুখে এ কথা জানতে পেরে রাজা শুদ্ধোদন পৌত্রের নাম রাখলেন “রাহুল।
গৌতম সিদ্ধান্ত
নিলেন, এ বন্ধন ছিন্ন করতে হবে। এ দিকে রাজা গৌতমকে আনন্দে রাখার জন্য নৃত্যগীতের আয়োজন
করলেন। কিন্তু সিদ্ধার্থ আমোদ-প্রমোদে মনোসংযোগ করতে পারলেন না, তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন।
নর্তকীরাও কুমারকে নিদ্রিত দেখে ইতস্ততভাবে এখানে-সেখানে ঘুমিয়ে পড়ল। গৌতম জেগে উঠে
এদের এলোমেলোভাবে ঘুমন্ত দেখে আরো বিরক্ত হলেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, আজই গৃহত্যাগ
করতে হবে। আষাঢ়ী পূর্ণিমার রাত, জ্যোৎস্নায় আলোকিত নগরী।
কুমার শেষবারের
মতো গোপাদেবীর ঘরে গেলেন। দেখলেন শিশুপুত্র রাহুল মায়ের সঙ্গে ঘুমাচ্ছে। পুত্রের
নিষ্পাপ মুখখানা দেখে তিনি একটু মায়া অনুভব করলেন, ভাবলেন একটু আদর করবেন। কিন্তু
আদর করতে গেলে গোপা জেগে উঠতে পারেন। নিজেকে নিবৃত্ত করলেন। নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে
এলেন। সারথি ছন্দককে ডেকে তুললেন। নির্দেশ দিলেন ঘোড়াকে প্রস্তুত করতে। ছন্দক অশ্বরাজ
কন্থককে সজ্জিত করে নিয়ে এলেন। সিদ্ধার্থ গৌতম কন্থকের পিঠে চড়ে নগর থেকে বেরিয়ে
ছুটে চললেন। তারপর তিনি অনোমা নদীর তীরে পৌছালেন।
গৃহ ত্যাগের পূর্ব মূহুর্তে পুত্র রাহুল ও রাহুল মাতা গোপাকে এক পাল দেখছেন |
এবার বিদায়ের
পালা। ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে গৌতম তরবারি দিয়ে নিজের দীর্ঘ কেশ কর্তন করলেন। রাজপোশাক
ও অলংকারগুলো খুলে ফেললেন। মুকুটটি ছন্দকের হাতে দিয়ে বললেন, ‘পিতাকে দিও।' রাজপোশাক
ও অলংকার মায়ের হাতে দিতে বললেন। গোপাদেবীকে তাঁর পাদুকাদ্বয় আর পুত্র রাহুলকে সোনার
তরবারি দিতে বললেন।
আদেশ দিলেন, ছন্দক
তুমি এবার ফিরে যাও। গৌতমের বিয়োগব্যথা সইতে না পেরে কন্থক তখনই প্রাণত্যাগ করল।
শোকাচ্ছন্ন ছন্দক ফিরে গেলেন কপিলাবস্তুতে। রাজপুত্র রাজসুখ ত্যাগ করে হলেন গৃহত্যাগী
সন্ন্যাসী। গৌতম একাকী হেঁটে চললেন অনোমা নদীর তীর ধরে গভীর বনের দিকে। আষাঢ়ী পূর্ণিমা
তিথিতে উনত্রিশ বৎসর বয়সে সিদ্ধার্থের এই গৃহত্যাগ বৌদ্ধ সাহিত্য ও ইতিহাস ‘মহাভিনিষ্ক্রমণ'
নামে অভিহিত।
সাধনারত জীবন
ছন্দককে বিদায়
দিয়ে গৃহত্যাগী সিদ্ধার্থ এক রক্তাম্বরধারী ব্যাধের সাথে বস্ত্র বিনিময় করেন। কৌষেয়
বস্ত্র ছেড়ে রক্তাম্বর পরিধান করলেন। তিনি তার কাছে আরও জানতে পারলেন অনতিদূরেই মহর্ষি
ভার্গব মুনির আশ্রম।
ভার্গব মুনির আশ্রমে
কিছুকাল অবস্থান করেন। পরে তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তিনি রাজগৃহের পথ ধরে অগ্রসর
হলেন আরাড় মুনির সন্ধানে। তিনি রত্নগিরি পর্বতের গুহায় কিছুকাল অবস্থান করেন। এ গুহা
ছিল বহু সাধকের আবাসস্থল। তিনি সেই সাধকদের কাছ থেকে জ্ঞান আহরণের চেষ্টা করলেন।
একদা ভিক্ষা সংগ্রহের
সময়ে রাজা বিম্বিসার এই তরুণ সন্ন্যাসীকে দেখে আকৃষ্ট হলেন। বিম্বিসার পরিষদসহ অগ্রসর
হলেন তার সাথে সাক্ষাৎ করতে। অনুরোধ করলেন কঠোর সন্ন্যাসজীবন ত্যাগ করে রাজসভার উচ্চপদ
গ্রহণ করতে। কিন্তু যিনি রাজসিংহাসন ছেড়ে এসেছেন, উচ্চপদ কিংবা সম্পদ কি তাঁকে লক্ষ্যচ্যুত
করতে পারবে? তিনি তো রাজ-ঐশ্বর্য বিসর্জন দিয়েছেন।
গৃহ ত্যাুুগের পর বিভিন্ন গুরুর সাথে কথা বলছেন সিদ্ধার্থ |
দীর্ঘদিন পর উপযুক্ত
গুরুর সন্ধান পেলে তিনি বৈশালীতে ঋষি আরাড় কালামের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তিনি তাঁর
কাছে শিখলেন ধ্যানের প্রক্রিয়া। পরে তিনি তাঁর আশ্রমও ত্যাগ করেন।
পরে সমসাময়িক
প্রখ্যাত শিক্ষাগুরু রামপুত্র রুদ্রকের নিকট কিছুকাল ধর্মচর্চা করলেন। একসময় তিনি
গুরুর সমকক্ষতা অর্জন করলেন। সে সঙ্গে উপলব্ধি করলেন, গুরুর শিক্ষা ও সাধনপ্রণালী তার
শিক্ষা অনেক উচ্চমার্গের হলেও এ দ্বারা সত্যজ্ঞান লাভ সম্ভব নয়। তিনি গুরুর কাছ থেকে
বিদায় নিয়ে রাজগৃহ ত্যাগ করলেন। আরাড় কালামের তিন শিষ্য-কৌণ্ডিন্য, বপ্প ও অশ্বজিৎ
এবং গুরু রামপুত্র রুদ্রকের দুই শিষ্য মহানাম ও ভদ্দিয় তাঁর সাথে যোগ দেন। রাজগৃহ
থেকে অনেক হেঁটে পৌছলেন উরুবেলায়। স্থানটি প্রকৃতির মনোরম পরিবেশে ঘেরা। তিনি সেনানী
নামে একটি গ্রামে এলেন। পাশেই গভীর বন। বয়ে চলেছে স্রোতস্বিনী নদী-নৈরঞ্জনা। এ নদীর
আরেক নাম ফল্গু। নির্জন প্রকৃতি গৌতমকে সব সময়ই আকৃষ্ট করত। ফলে জায়গাটি তাঁর খুব
পছন্দ হলো। সিদ্ধান্ত নিলেন, দুঃখের শেষ জ্ঞান লাভের ও জানার জন্য এখানেই তপস্যায়
রত হবেন।
মধ্যম পথ অবলম্বন
কঠোর সাধনায় পেরিয়ে
গেল ছয়টি বছর। জীর্ণ-শীর্ণ হয়ে গেলো গৌতমের সুন্দর দেহসৌষ্ঠব। দুর্বল শরীরে হাঁটা
চলায় অক্ষম হয়ে গেলেন। তিনি এতই দুর্বল ছিলেন যে একদিন নদীতে স্নান করতে নেমে আর
উঠতে পারছিলেন না। অনেক কষ্টে পাশের একটি বড় গাছের শাখা ধরে তিনি পাড়ে উঠতে সক্ষম
হলেন। তিনি অনুধাবন করলেন, এভাবে কঠোর সাধনা তাঁকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবে। দুঃখমুক্তির
উপায় জানা সম্ভব হবে না। তিনি উপলব্ধি করলেন, অল্প অল্প আহার করে মধ্যপথ অবলম্বনই
হবে সাধনার প্রকৃত পথ। কঠোর সাধনা বা বিলাসী জীবন, কোনোটিই দুঃখমুক্তির অনুকূল নয়।
সুতরাং তিনি মধ্যম পথ অবলম্বন করলেন।
সুজাতার পায়েস দান
শ্ৰমণ গৌতমকে আহার
করতে দেখে অনুগামী পাঁচজন শিষ্য কৌণ্ডিন্য, বপ্প, ভদ্দিয়, মহানাম ও অশ্বজিৎ তাকে ছেড়ে
চলে গেলেন। তিনি একা হয়ে গেলেন।
একদিন স্নান করে
তিনি বিশাল অশ্বথ বৃক্ষের তলায় উপবেশন করলেন। এসময় সুজাতা' নামে সেনানী গ্রামের এক
গৃহবধূ শ্ৰমণ গৌতমকে পায়েস দান করলেন। গৌতম সুজাতার পায়েস গ্রহণ করলেন। ঐদিন ছিল
বৈশাখী পূর্ণিমা তিথি। পায়েসান্ন খেয়ে তিনি পুনরায় ধ্যানে বসলেন। প্রতিজ্ঞা করলেন,
বুদ্ধত্ব লাভ না করে তিনি এই আসন থেকে উঠবেন না।
মার বিজয় ও বুদ্ধত্বলাভ
আকাশে বৈশাখী পূর্ণিমার
চাঁদ। অশ্বত্থামূলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ গৌতম গভীর ধ্যানে নিমগ্ন। দুঃখ-মুক্তির অন্বেষায়
তিনি সাধনারত। ধরনী প্রকম্পিত হলো। লোভ-লালসা, কামনা-বাসনা, ভয়ভীতি প্রভৃতি অশুভ
শক্তির প্রতীক মার তাঁর এই প্রতিজ্ঞায় ভয় পেয়ে গেলেন। তাঁকে লক্ষ্যচ্যুত করার জন্য
দলবলসহ মার নানারকম চেষ্টা করতে থাকল। তুমুল যুদ্ধ হলো। রতি, আরতি ও তৃষ্ণা মারের
এই তিন কন্যা পুষ্পধনু ও পঞ্চশর নিয়ে ধ্যানমগ্ন বোধিসত্ত্বকে আক্রমণ করল। তাঁর তপোভঙ্গ
করার জন্য নানারকম অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন ও ছলনা করতে থাকল। শুরু হলো মারের সঙ্গে তর্কযুদ্ধ।
তিনি দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, যদি পর্বত, মেরু স্থানচ্যুত হয়, সমস্ত জগৎ শূন্যে মিশে
যায়, সমস্ত নক্ষত্র, জ্যোতিষ্কও ইন্দ্রের সাথে ভূমিতে পতিত হয়, বিশ্বের সকল জীব একমত
হয় এবং মহাসমুদ্র শুকিয়ে যায়, তথাপি আমাকে এই আসন থেকে বিন্দু মাত্র বিচলিত করতে
পারবে।
কঠোর সাধানারত সিদ্ধার্থ গৌতম |
যুদ্ধে মার শাক্য
সিংহের নিকট পরাজিত হলো। বোধিজ্ঞান লাভ করে সিদ্ধার্থ গৌতম ’বুদ্ধ’ হলেন। তখন তাঁর
বয়স হয়েছিল পঁয়ত্রিশ বছর।
বুদ্ধত্ত্ব লাভ
করে ধ্যানে বসে তিনি রাতের প্রথম প্রহরে জাতিস্মর জ্ঞান বা পূর্বজন্মের বিষয়ে জ্ঞান
লাভ করলেন। রাতের দ্বিতীয় প্রহরে দিব্যচক্ষুসম্পন্ন হলেন। তৃতীয় প্রহরে জন্ম, জরা,
ব্যাধি ও মৃত্যুর উৎপত্তির বিষয়ে অবগত হলেন। চার আর্যসত্য উপলব্ধি করলেন। দুঃখনিরোধের
উপায় আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ আবিষ্কার করলেন।
‘বোধি’ শব্দের
অর্থ পরম জ্ঞান বা শ্রেষ্ঠ জ্ঞান। বোধি অর্জন করে তিনি বুদ্ধ হয়েছিলেন। যে অশ্বত্থ
গাছের নিচে তিনি বুদ্ধত্ব লাভ করলেন তার নাম হলো ‘বোধিবৃক্ষ' বা বোধিদ্রুম। তিনি
জগতে ‘গৌতমবুদ্ধ' নামে পরিচিত হন। যে স্থানে তিনি বুদ্ধত্ব লাভ করেন তা ‘বুদ্ধ গয়া'
নামে পরিচিত।
মারে তিন কন্যা দ্বার ধ্যান ভাঙ্গার চেষ্টা |
বুদ্ধত্বলাভের
পরে তাঁর বোধিসত্ত্ব জীবনের সমাপ্তি হয়। তিনি নির্বাণ মার্গের জ্ঞান লাভ করেন। তিনি
প্রত্যক্ষ করলেন অবিদ্যা বা অজ্ঞানতাই আমাদের সকল দুঃখের কারণ। অবিদ্যার ধ্বংসের দ্বারা
দুঃখের বিনাশ সম্ভব।
বুদ্ধত্বলাভের
পরে তিনি হলেন জ্যোতির্ময়, জগতে ধ্বনিত হলো আনন্দধ্বনি। তৃষ্ণার ক্ষয় করে তিনি দুঃখকে
জয় করেছেন, জন্মমৃত্যুর বন্ধন ছিন্ন করেছেন।
ধর্মচক্র প্রবর্তনসূত্র
বুদ্ধত্ব লাভের
পরে বুদ্ধ তাঁর নবলব্ধ ধর্মপ্রচারের সিদ্ধান্ত নিলেন। এজন্যে তিনি আষাঢ়ী পূর্ণিমা
তিথিতে সারনাথের ঋষি পতন মৃগদাবে উপস্থিত হলেন। ঐখানে তখন অবস্থান করছিলেন তাঁর পূর্বের
পাঁচ সঙ্গী: কৌণ্ডিন্য, বপ্প, ভদ্দিয়, মহানাম ও অশ্বজিৎ। এঁদের কাছেই তিনি প্রথম নবলব্ধ
ধর্মপ্রচার করলেন। এঁরাই বুদ্ধের কাছে প্রথম দীক্ষাপ্রাপ্ত ভিক্ষু।
পঞ্চবর্গীয় শীষ্যদের ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্র দেশনা |
বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে
এরা ‘পঞ্চবর্গীয় শিষ্য' নামে পরিচিত। তাঁদের দীক্ষার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা লাভ করলো
‘ভিক্ষুসংঘ’। বুদ্ধের প্রথম ধর্মদেশনা ‘ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্র’ নামে খ্যাত।
বুদ্ধের বর্ষাবাস
বুদ্ধ দেশনা করলেন,
নব আবিষ্কৃত চতুরার্য সত্য, আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ, প্রতীত্যসমুৎপাদ তত্ত্ব, অনিত্য
ও অনাত্নাবাদ ইত্যাদি। পঞ্চশিষ্যগণ বিমুগ্ধ চিত্তে সারারাত ধরে নবধর্মের অমৃতময় বাণী
শ্রবণ করলেন। বুদ্ধ পঞ্চবর্গীয় শিষ্যদের নিয়ে ঐ তপোবনেই প্রথম বর্ষাবাস শুরু করলেন।
এ সময়ে শ্রেষ্ঠীপুত্র যশ ও তাঁর চার বন্ধু সংসারের প্রতি বীতরাগ হয়ে বুদ্ধের নিকট
প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন। এঁদের অনুসারী আরো পঞ্চাশজন যুবকও ভিক্ষু হলেন।
বুদ্ধ এই ভিক্ষুসংঘকে
বর্ষাবাস শেষে দিকে দিকে নব ধর্মপ্রচারে প্রেরণ করলেন। তিনি বললেন,
‘মুত্তাহং ভিখবে
সব্বপাসেহি, যে দিব্বা যে চ মানুসা, তুমহে পি ভিখবে মুত্তা সব্বপাসেহি যে দিব্ব যে
চ মানুসা, চরথ ভিখবে চারিকং বহুজন হিতায বহুজন সুখায় লোকানুকম্পায, অস্থায হিতায
সুখায দেবমনুস্সানং মা একন দ্বে অগমিথ, দেসেথ ভিখবে ধম্মং আদিকল্যাণং, মজে কল্যাণং
পরিসোনকল্যাণং।
ভিক্ষু সংঘকে ধর্ম দেশনা ও নির্দেশনা প্রদান |
অর্থাৎ, হে ভিক্ষুগণ!
আমি দেব-মনুষ্য এবং সকলপ্রকার সংযোজন হতে মুক্ত। ভিক্ষুগণ! তোমরাও দেব-মনুষ্য এবং
সকলপ্রকার সংযোজন হতে মুক্ত হও। হে ভিক্ষুগণ! বহুজনের মঙ্গলের জন্য, কল্যাণের জন্য
তোমরা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়। দুজন একত্রে গমন করবে না, প্রচার কর সেই ধর্ম যে ধর্মের
আদিতে, মধ্যে এবং অন্তে কল্যাণ।
বুদ্ধ এরূপ নির্দেশ
প্রদান করে নিজে উরুবেলার সেনানী গ্রামের উদ্দেশে যাত্রা করলেন। বুদ্ধ উরুবেলায় গিয়ে
কাশ্যপ, নদী কাশ্যপ ও গয়াকাশ্যপ এ তিন ভাইকে সদ্ধর্মে দীক্ষা দেন। তাঁদের অনুগামী
অনেক শিষ্যও বুদ্ধের ধর্মবাণী শুনে দীক্ষিত হন।
বুদ্ধ উরুবেলা
থেকে রাজগৃহে যাত্রা করলেন। বুদ্ধের আগমনে রাজা বিম্বিসার তাঁকে স্বাগত জানালেন। সেখানে
রাজবৈদ্য জীবকসহ রাজা বিম্বিসারকে বুদ্ধ ত্রিশরণে প্রতিষ্ঠিত করলেন। বিম্বিসারের আত্মীয়
স্বজনসহ আরো অনেকেই গৃহীশিষ্য হলেন।
অনেক শিষ্য নিয়ে
সঞ্জয় পরিব্রাজক রাজগৃহের পাশেই বাস করতেন। সারিপুত্র ও মৌগল্যায়ন প্রথম তাঁর শিষ্য
ছিলেন। বুদ্ধশিষ্য অশ্বজিত একদিন ভিক্ষা করতে করতে সারিপুত্রের নিকটবর্তী হলে তিনি
অশ্বজিতের সৌম্য চেহারা দেখে মুগ্ধ হয়ে তাঁর কাছে এলেন। অশ্বজিত সারিপুত্রকে ‘হেতুতেই
সকল কার্যের উৎপন্ন দেশনা করতেই তিনি শ্রোতাপত্তি ফলে প্রতিষ্ঠিত হলেন। সারিপুত্র স্থবির
মৌদগল্যায়কে সাথে নিয়ে রাজগৃহে বুদ্ধের কাছে উপস্থিত হলেন। এখানে উভয়ে বুদ্ধের কাছে
দীক্ষা নিয়ে অগ্রশ্রাবক হন।
স্বগৃহে ধর্ম প্রচার
শাক্যরাজ শুদ্ধোদন
রাজগৃহে তথাগত বুদ্ধ অবস্থান করছেন শুনে তাঁকে কপিলাবস্তুতে আনার জন্য পুরোহিত পুত্র
উদায়ীকে পাঠান। তাঁর অনুরোধে বুদ্ধ কপিলাবস্তুতে উপস্থিত হয়ে ধর্মের তত্ত্বকথা দেশনা
পূর্বক পিতা শুদ্ধোদন, পুত্র রাহুল ও স্ত্রী যশোধরাকে দীক্ষা দেন। এভাবে আনন্দ, অনিরুদ্ধ,
নন্দ, দেবদত্ত, উপালিসহ শাক্যবংশীয় অনেক কুলপুত্র বুদ্ধের ধর্মবাণী শুনে ভিক্ষুসংঘে
যোগদান করেন।
পরবর্তীকালে শ্রাবস্তীর
শ্রেষ্ঠী সুদত্ত (অনাথপিণ্ডিক), বিশাখা প্রমুখ অনেক ধনী ব্যক্তি সদ্ধর্ম গ্রহণ করে
বৌদ্ধধর্মের হিতসাধনে আত্মনিয়োগ করেন। জেতবন বিহার শ্রেষ্ঠী অনাথপিণ্ডিকেরই দান।
কোশল রাজ প্রসেনজিত ও অঙ্গুলিমাল দুজন যথাক্রমে গৃহীশিষ্য ও ভিক্ষুশিষ্য হিসেবে খ্যাতি
লাভ করেন। লিচ্ছবী মল্লরা বুদ্ধের ভক্ত হিসেবে সুপরিচিত।
বুদ্ধ বৈশালীতে
অবস্থানকালে মহাপ্রজাপতি গৌতমীর নেতৃত্বে পাঁচশত শাক্যবংশীয় মহিলা ভিক্ষুণী হিসেবে
দীক্ষা নেন। সেদিনই ভিক্ষুণীসংঘ প্রতিষ্ঠা হল। এভাবে তথাগত বুদ্ধ সুদীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ
বছর ধরে ধর্মপ্রচার করেন।
মহাপরিনির্বাণ
গৌতম বুদ্ধ সুদীর্ঘ
পয়তাল্লিশ বছর দিকে দিকে বিচরণ করে যে ধর্মের আদি, মধ্য ও অন্তে কল্যাণ তা প্রচার
করেন। অতঃপর, এক মাঘী পূর্ণিমার দিনে তিনি বৈশালীর চাপাল চৈত্য নামক উদ্যানে অবস্থান
করছিলেন।
সেই সময় পাপমতি
মার তাঁর কাছে উপস্থিত হয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করল, ‘ভন্তে, ভগবান, এখন আপনি
পরিনির্বাপিত হোন। ভন্তে এখন আপনার পরিনির্বাণ প্রাপ্তির উপযুক্ত সময় হয়েছে। বুদ্ধ
বললেন, তুমি নিশ্চেষ্ট হও, অচিরেই তথাগতের পরিধান হবে। এখন থেকে তিনমাস পর তথাগত পরিনির্বাণ
প্রাপ্ত হবে।
একথা শুনে বুদ্ধের
প্রধান সেবক আনন্দ নিবেদন করলেন, হে প্রভু ভগবান! বহুজনের সুখ ও হিতের জন্য আপনি কল্পকাল
অবস্থান করুন। ভগবান বললেন, ‘তথাগত ইচ্ছা করলে কল্পকাল অবস্থান করতে পারেন। কিন্তু
আনন্দ! তথাগত আয়ুষ্কাল পরিত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। নিশ্চয়ার্থক বাক্য ভাষিত হয়েছে।
তথাগত সেই বাক্য প্রত্যাহার করবেন তা সম্ভব নয়।
অতঃপর বুদ্ধ আনন্দকে
নিয়ে মহাবনে টাগারশালায় গমন করলেন। সেখানে গিয়ে তিনি বৈশালীতে অবস্থানরত ভিক্ষুসংঘকে
বললেন, “তোমরা আমার দেশিত ধর্মসমূহ উত্তমরূপে আয়ত্ত করে পূর্ণরূপে আচরণ কর, গভীরভাবে
চিন্তা কর এবং সেগুলো সর্বত্র প্রচার কর। এগুলো বহুজনের জন্য হিত ও সুখকর।”
গৌতম বুদ্ধের মহাপরিনির্বান লাভ |
এরপর ভগবান ভিক্ষুসংঘসহ আনন্দকে নিয়ে ভণ্ডগ্রাম এসে উপস্থিত হলেন। এখানে ভগবান ভিক্ষুদের সম্বোধন করে বললেন, “শীল, সমাধি, প্রজ্ঞা ও অনুত্তর বিমুক্তি এ চার প্রকার পরিশুদ্ধ শীলে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে সমাধিস্থ হলে মহাফল লাভ হয়, সম্যক সমাধি দ্বারা সম্যকরূপে বিমুক্ত হয়”।
ভগবান অতঃপর হস্তিগ্রাম,
অশ্বগ্রাম, জম্বুগ্রাম, ভোগনগর প্রভৃতিতে অবস্থান করলেন। ভোগনগরের আনন্দ চৈত্যে অবস্থানকালে
তিনি ভিক্ষুসংঘকে বললেন, “তোমরা নিজেরাই নিজেদের আশ্রয়স্থল। নিজেরাই নিজেদের শরণ
হয়ে বিহার কর। অন্য কারো শরণ নিও না।”
আনন্দ, “তোমাদের
মনে হতে পারে, শাস্তার উপদেশ শেষ হল, আমাদের বুদ্ধ আর নেই। এ ধারণা কখনো কর না।
আমার দেশিত ধর্ম-বিনয়,
আমার অবর্তমানে তোমাদের শাস্তা। ধর্ম ও বিনয় যতদিন জগতে প্রতিষ্ঠিত থাকবে ততদিন আমি
বর্তমান থাকব।'
“প্রবীণ ও নবীন
ভিক্ষুর প্রতি যার যা কর্তব্য তা সম্পাদন করবে। শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞাযুক্ত হয়ে কাম,
ভব, দৃষ্ট ও অবিদ্যাকে ধ্বংস করে সম্পূর্ণরূপে বিমুক্ত হও।”
“যারা সুগভীর ও
সুবিস্তীর্ণ তৃষ্ণা নদী পার হয়েছেন, তাঁরা আমার্গ সেতু দিয়ে ভব সাগর উত্তীর্ণ হন।
তাদের তরী প্রয়োজন হয় না। সাধারণ লোকই ভেলা বেঁধে নদী উত্তীর্ণ হয়।”
“সকল বস্তুই বিনাশশীল,
অপ্রমাদযুক্ত হয়ে বিহার কর।”
“কোন ভিক্ষু ধর্ম
এরূপ, বিনয় এরূপ এটি শাস্তার শাসন এরূপ বলতে পারে। আমার ভাষিত বাক্যের প্রতি পদ, বর্ণ
সাবধানে গ্রহণ করে সূত্র অবতারণা ও বিনয় সন্দর্শন করবে। মিল না হলে ভগবানের বচন নয়
ধরে নেবে। মিল হলে সিদ্ধান্ত নেবে যে, এটি নিশ্চয় ভগবানের বচন।”
এরপর ভগবান পাবা
নগরে উপস্থিত হলেন। এখানে স্বর্ণকার পুত্র চুন্দের আম্রকাননে অবস্থান করলেন। চুন্দ
ভগবান বুদ্ধকে তাঁর গৃহে নিমন্ত্রণ জানালেন। চুন্দের গৃহে ‘সুকর মদ্দব’সহ অন্ন ভোজনের
পর ভগবান বুদ্ধ রোগাক্রান্ত হলেন।
অতঃপর ভগবান আয়ুষ্মন
আনন্দ ও মহাভিক্ষুসংঘ সহ হিরণ্যবতী নদীর তীরে কুশীনারার উপবর্তনে মল্লরাজাদের শালবনে
উপনীত হলেন। সেখানে বুদ্ধ আনন্দকে শালবৃক্ষের অন্তবর্তী স্থানে উত্তর শীর্ষ করে মঞ্চ
স্থাপন করতে বললেন। আনন্দ শয্যা স্থাপন করলে ভগবান স্মৃতি ও জ্ঞানযোগে দক্ষিণপদের
উপর বামপদ রেখে ডানপাশে হয়ে শয়ন করলেন।
সে সময় যমক শালবৃক্ষের
সর্বাঙ্গে অকাল পুষ্প প্রস্ফুটিত হয়ে পুষ্পময় হয়ে উঠল। আকাশ থেকে চন্দন চূর্ণ ও
পুষ্প বর্ষিত হল। জগতগুরু ভগবান তথাগত সুদীর্ঘ পয়তাল্লিশ বছর ধর্ম প্রচার শেষে আশি
বছর বয়সে খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৩ অব্দে শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে মহাপরিনির্বাণ প্রাপ্ত
হলেন।
আমাদের কমেন্ট করার জন্য ধন্যবাদ। আমরা আপনার কমেন্ট পড়া মাত্র প্রতিক্রিয়া জানাতে চেষ্টা করবো।